ঢাকা, শুক্রবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিশ্ব মা দিবস

লেখাপড়ার সুযোগ মেলেনি, সন্তানদের করেছেন উচ্চ শিক্ষিত

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৯ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২৪
লেখাপড়ার সুযোগ মেলেনি, সন্তানদের করেছেন উচ্চ শিক্ষিত

মেহেরপুর: তখন বয়স মাত্র ১১ কিংবা ১২ বছর। খুব ইচ্ছে ছিল পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দেব।

লেখাপড়া মাত্র তিন ক্লাস পর্যন্ত। পরে বাবা মায়ের ইচ্ছাতেই পাশের গাঁড়াডোব গ্রামের কোবাদ আলী শেকের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় আমার।  

কথাগুলো বলছিলেন সফল জননী নুরজাহান খাতুন (৮০)। তিনি বলেন, লেখাপড়া শিখতে না পারার যন্ত্রণা থেকেই শপথ নিয়েছিলাম ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করব। আর সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই সংগ্রাম শুরু করেছিলাম সন্তানদের মানুষ করার। সফল হয়েছি কিনা জানি না, তবে আমার সব সন্তান উচ্চ শিক্ষিত। এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত।

রোববার (১২ এপ্রিল) বিশ্ব মা দিবস। মা দিবসের এই দিনে গাঁড়াডোব গ্রামে তার নিজ বাড়িতে নুরজাহানের সঙ্গে কথা হলে তার সংগ্রাম ও সফলতার কথা জানান তিনি।
 
‘সফল জননী’ হিসেবে নুরজাহান খাতুন গাংনী উপজেলা পর্যায় ও মেহেরপুর জেলা পর্যায় থেকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি সরূপ পেয়েছেন জয়িতা পুরস্কার।

জানা যায়, তার যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি শেষ করে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছেন মাত্র। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিন নম্বর তিনি। বাবা মোহাম্মদ আলী ছিলেন একজন কৃষক। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় নুরজাহানকে তার বাবা বিয়ে দেন। স্বামী কোবাদ আলী শেখ তখন বরিশাল বিএডিসিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। স্বামীর ঘরে যাওয়ার পর নুরজাহানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় তার পড়া শোনার স্বপ্ন। তখন তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নেন ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাবেন।

এলাকায় একজন সফল মা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন নুরজাহান খাতুন। জীবনযুদ্ধে নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি তার সব ছেলে মেয়ে এখন প্রতিষ্ঠিত। ১০ ছেলে মেয়ে সবাই মাস্টার্স পাশ। প্রথম ছেলে আনিসুর রহমান, কুষ্টিয়া জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা। মেজো ছেলে আনছারুল হক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের পরিদর্শক। তৃতীয় ছেলে এসএম আইনুল হক বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি এবং বর্তমানে সুইডেনে নাগরিকত্ব অর্জন করে সেখানকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। চতুর্থ ছেলে মাসুদুজ্জামান গাংনী উপজেলার বাহগুন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। পঞ্চম মেয়ে মোছা. নাসিমা খাতুন গাংনী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা। ষষ্ঠ ছেলে শাহাজাহান আলী গাংনী উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে সিনিয়র অডিটর, সপ্তম ছেলে আলমগীর হোসেন জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সময়ের আলো সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, অষ্টম মেয়ে নাজমা খাতুন মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত, নবম ছেলে জিল্লুর রহমান এফবিসি, আইসি ইউনিভার্সিটিতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। কনিষ্ঠ মেয়ে তাসলিমা আক্তার বিসিএস নন ক্যাডারে কুষ্টিয়া ভূমি অফিসে কর্মরত রয়েছেন।

নুরজাহান খাতুন বলেন, জীবনের সব ক্ষেত্রে তিনি সফলতা পেয়েছি। ছেলে মেয়েদের সফলতা আমাকে গর্বিত করেছে। ছেলেমেয়েদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি। এখন আমার পরিবারের সবাই চাকরিজীবী। আমার সন্তানদের বলেছি, জীবনে অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে। সমাজের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।

কঠিন সময়ে ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যে কোনো কাজে সদিচ্ছা, সততা, স্বচ্ছতা ও চেষ্টা থাকলে মানুষ সফল হবেই। কারও ওপর নির্ভর না করে নিজের জীবন নিজেকেই গোছাতে হবে। সফল হওয়ার পেছনে এটাই হচ্ছে মূলমন্ত্র।

তার মেয়ে গাংনী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার নাছিমা খাতুন। নিজ মা সম্বন্ধে তিনি বলেন, আমার মা একজন ভালো মানুষ। তিনি সব বাঁধা পেরিয়ে একজন সফল নারী। আমার বাবা ১৯৯৬ সালে মারা যাওয়ার পর পরিবারে হাল ধরার মত কেউ ছিল না। মা একাই ১০ ভাই বোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন। বাবা যখন মারা যান আমরা কেউ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কলেজে কেউ মাধ্যমিক নয়তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে গ্রামের মানুষের কাছেও শুনতে হয়েছে নানা ধরনের কটুকথা। তারপরেও তিনি থেমে যাননি। সবকিছু উপেক্ষা করে আমাদের মানুষ করেছেন তিনি।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের মেহেরপুর জেলার সাবেক প্রতিনিধি ও বর্তমান সুইডেন প্রবাসী এসএম আইনুল হক সুইডেন থেকে ভিডিও বার্তায় বলেছেন, আমাদের মা একজন আদর্শ মা। মায়ের অনুপ্রেরণাতেই আজ আমরা সব ভাইবোন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। গৃহিণী হিসেবে সংসারের সব কাজকর্ম করে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার তদারকি করতেন মা।

মায়ের নির্দেশ ছিল সন্ধ্যায় হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে পড়তে বসা। তিনি শত কাজ করার পরেও পড়ার টেবিলের পাশে বসে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খোঁজ খবর নিতেন। নিজ নিজ ছেলে মেয়েদের পাশে থেকে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি আদর্শবান সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সব মায়েদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

প্রতিবেশী আয়েশা খাতুন বলেন, প্রতিবেশী হিসেবে তিনি আমার দাদি শাশুড়ি সম্পর্ক হন। নুরজাহান খাতুন খুব ভালো মানুষ। তার সব ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত। সবাই ভালো চাকরি করেন। আমার শাশুড়ির কাছে শুনেছি নুরজাহান খাতুন তার ছেলে মেয়েকে দেখার পাশাপাশি শ্বশুর শাশুড়িকেও খুব যত্ন করতেন। তিনি এ এলাকার একজন আদর্শ মায়ের উদাহরণ।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।