ঢাকা, সোমবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ জুলাই ২০২৪, ২৩ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

খুলনায় ফয়সালের বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, মুখ খুলছে না কেউ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০২৪
খুলনায় ফয়সালের বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, মুখ খুলছে না কেউ

খুলনা: ‘লাখ টাকার বাগান খাইলো দেড় টাকার ছাগলে’ এই বাক্যটি এখন দেশের সব মানুষের মুখে মুখে। যে ব্যক্তির কারণে বাক্যটি পরিচিতি পেয়েছে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমান ওরফে পিন্টু।

যার রয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ; সম্পদ। দুই স্ত্রী ও সন্তানসহ স্বজনদের নামে তিনি গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

কিন্তু রাখালের পালের (সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক শাহ ইমরান হোসেন) একটি ‘বিটল জাতের ছাগল’ মতিউরের সব দুর্নীতি দেশের মানুষের সামনে নিয়ে আসে। বাবার পরিচয় হারান ছাগলটি কেনা মুশফিকুর রহমান ইফাত। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতাও এখন বাবাকে ছেড়ে কথা বলছেন না। এক ছাগলের কারণে মতিউর যেমন হারাচ্ছেন দুর্নীতি করে কামানো সমস্ত সম্পদ, তেমনি হারাতে বসেছেন স্ত্রী-সন্তান-স্বজনদেরও।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের খুলনার বাড়ি

ছাগলের কারণে মতিউর ও তার পরিবার যেমন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’, ঠিক তেমনই ‘টক অব দ্য খুলনায়’ পরিণত হয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। তার থলে থেকে যে কালো বিড়াল বের হচ্ছে, দুদিন পরে তিনিও দেশের শীর্ষ আলোচনায় চলে আসবেন।

খুলনার এই ‘কৃতি সন্তানের’ বাড়ির আঙ্গিনায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাগান। যেখানে শোভা পাচ্ছে বেদানা, জাম, লেবু, পেয়ারা, নারকেলসহ নানা প্রজাতির ফুল ও গাছ। নগরের যশোর রোডের নেছারিয়া মাদ্রাসার পাশে প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর বিলাসবহুল তিনতলা বাড়িতে প্রতিনিয়ত মুগ্ধতা ছড়ায় বাগানের এসব ফুল ও ফল।

এই বাড়ি ও বাগানের পেছনে রয়েছে অবৈধ অর্থ। লোকে সব জানে, কিন্তু ‘সরকারি আমলা’ হওয়ায় তার ব্যাপারে কোনো এক অজানা আতঙ্কে কেউ মুখ খোলে না। বাংলানিউজ এ বিষয়ে জানতে পেরে এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে।

জানা গেছে, সরকারি চাকুরে হয়েও ফয়সাল ব্যবহার করেন একটি সাদা রঙের টয়োটো ‘হ্যারিয়ার’ গাড়ি। এ বাহনে তিনি ও তার স্ত্রী আফসানা জেসমিন এবং তাদের স্বজনরা চলাচল করেন। নগরের মুজগুন্নী এলাকায় প্রায় দুই বিঘা জমির একটি প্লটও রয়েছে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের খুলনার বাড়ি

রাজধানী ঢাকায় তার নামে রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, আছে ১০ কাঠার দুটি প্লট। নামে বেনামেও সম্পদ রয়েছে তার। এ ছাড়া তার ও তার স্ত্রীসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা মূল্যের সঞ্চয়পত্রও রয়েছে। যা অবরুদ্ধ করেছেন আদালত।

এনবিআরের প্রথম সচিব এত বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে। এ বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। প্রাথমিকভাবে দুদকের অনুসন্ধান দল ঢাকায় তার ফ্ল্যাট, দুটি প্লট, সঞ্চয়পত্রসহ ১৬ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) এনবিআর প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেন। তারপর থেকে দুর্নীতির টাকায় গড়া ফয়সালের সম্পদের পাহাড় সম্পর্কে তথ্য মেলা শুরু হয়।

এনবিআরের প্রথম সচিব ফয়সালের পৈত্রিক আবাস খুলনার মুজগুন্নী এলাকার কাজী বাড়ি। তার বাবার নাম কাজী আব্দুল হান্নান অরফে হিরু কাজী। শনিবার (২৯ জুন) খুলনার বাড়িগুলো পরিদর্শনে যায় বাংলানিউজের প্রতিবেদক। কিন্তু বাড়িগুলোর গেটে তালা দেখতে পাওয়া যায়। ভেতরে লোকজনের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, তবে গণমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে সামনে আসেননি।

তাই স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে চায় বাংলানিউজ। কিন্তু তারাও কোনো এক কারণে ফয়সালের ব্যাপারে কথা বলতে চাননি।

আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জমাকৃত নথি সূত্রে জানা গেছে, এনবিআর প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে ১৮টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। দুদক এসব ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা হওয়া এবং পরে তার বড় অংশ উত্তোলনের তথ্য পেয়েছে।

ফয়সালের শ্বশুর আহমেদ আলী একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তার শাশুড়ি মমতাজ বেগম পেশায় গৃহিণী। দুদক বলছে, ফয়সাল ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিজের ও স্ত্রীর নামে রাখার পাশাপাশি স্বজনদের নামেও রেখেছেন। শ্বশুর ও শাশুড়ির নামের ব্যাংক হিসাবে যে অর্থ লেনদেন হয়েছে, তা ফয়সালেরই অপরাধলব্ধ আয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের গাড়ি

দুদকের নথি অনুযায়ী, ফয়সাল ও তার ১১ স্বজনের নামে ১৯টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে তার শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে। ফয়সাল তার অপরাধলব্ধ আয় লুকাতে স্বজনদের নামে ৭০০টির মতো ব্যাংক হিসাব খুলেছিলেন। এর মধ্যে দুদক ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে।

> > ফয়সালের সম্পদ কত জানতে ক্লিক করুন

এনবিআরের সচিবের বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া জনমনে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। যারাই প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকেন তারাই কি অনায়াসে বিপুল সম্পদের মালিক হতে পারেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে।

এনবিআরের প্রথম সচিবের অর্থ-সম্পদ নিয়ে করা প্রশ্নে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী মাহফুজুর রহমান লিটন বলেন, কাজী ফয়সাল এলাকায় কম আসতেন। তবে তার পরিবারকে সবাই স্থানীয় সম্পদশালী হিসেবে জানে। তার স্ত্রী আফসানা জেসমিন খুলনায় টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়িতে ঘোরাফেরা করতেন।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বাড়ি খুলনায় হওয়ায় প্রথমে আমাদের গর্ব ছিল। কিন্তু এখন তা আমাদের জন্য লজ্জাকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার এসব দুর্নীতির অর্থের রাজ প্রাসাদের খবর দেখে আমরা বিস্মিত হয়ে পরেছি। সরকারের উচিত এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অবিলম্বে শাস্তির আওতার আনা।

তিনি আরও বলেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়ালে যেসব আইন ও বিধির মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সেসব আইন ও বিধি শিথিল করা হয়েছে যে কারণে শাস্তির মাত্র কমে গেছে। এতে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি-অনিয়ম বেড়েছে। তিনি দাবি জানান দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তি সরকারের কোষাগারে নিয়ে নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, জুন ২৯,  ২০২৪
এমআরএম/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।