মেহেরপুর: নির্মাণ কাজ চলছে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের। এ সড়ক নির্মাণের বাজেট ৬৪৩ কোটি টাকা।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জহিরুল লিমিটেডের লোকজন তড়িঘড়ি করে গোজামিল দিয়ে ভেঙে যাওয়া স্থানগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করেছেন।
তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, সড়কের কাজ চলমান। যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেনো নির্দিষ্ট সময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়া হবে। সিডিউল মেনেই সড়ক নির্মাণ কাজ চলছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ সড়কটি নিমার্ণ শুরুর পর থেকেই নানা অনিয়ম ও নিম্নমানের বালু ও খোয়াসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হলো সম্প্রতি, ১০ মিনিটের বৃষ্টিতেই পিচ ঢালাই করা রাস্তাটির দুই পাশ দিয়ে ভাঙতে শুরু করে।
সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, এজিং (কিনারা) ভেঙে হুমকির মুখে পড়েছে নির্মাণাধীন দেড় কিলোমিটার সড়ক। এতে করে নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সড়কের বিভিন্ন অংশের এজিং ভেঙে পাশের জমিতে চলে গেছে। ফাটল দেখা দিয়েছে সড়কের বিভিন্ন স্থানে। সামান্য বৃষ্টিতেই কোনো কোনো স্থানে কার্পেটিং উঠে এজিং ভেঙে গেছে। কাজে নিম্নমানের ইট, খোয়া, পাথর, বালু ব্যবহার করার কারণে সড়কের কয়েকটি কয়েকটি স্থানে উঁচু নিচু হয়ে দেবে গেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
এছাড়া পাকা সড়কের দুই পাশে কমপক্ষে তিন ফুট মাটি থাকার কথা। অথচ অধিকাংশ সড়কেই এ নিয়ম মানা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি একটি ট্রাক রাস্তার পাশে দাঁড়ালে সে স্থান দেবে গিয়ে ট্রাকটি রাস্তার পাশের খাদে উল্টে যায়।
তিনি বলেন, সড়কটি একদিকে নির্মাণ চলছে। আরেকদিকে থেকে ভেঙে যাচ্ছে। মূলত নিম্নমানের কাজের কারণেই এমনটা হচ্ছে।
স্থানীয় রাকিবুল ইসলাম বলেন, নির্মাণ কাজ চলছে, এরই মধ্যে সড়ক ভাঙছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কর্তৃপক্ষের উচিত ঠিকাদারের কাজের মান যাচাই করা। এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করা ঠিক নয়।
নিয়ম অনুযায়ী এলাকার বাইরে থেকে মাটি এনে রাস্তার দুই পাশ ভরাট করার শর্ত থাকলেও তা অগ্রাহ্য হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাস্তার পাশে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তার পাশে মাটি ভরাট করেছে। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই রাস্তার পাশে দেওয়া ওই মাটি ধসে রাস্তা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে, জানান স্থানীয় লোকজন।
সড়কটিতে রয়েছে কয়েকটি কালভার্ট। কালভার্ট নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের ইট, খোয়া আর ঢাকার লোকাল পূর্বাচল রড। স্থানীয়রা এ বিষয়টিতে বাধা দিলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হুমকিতে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
এদিকে গাংনীর আখ সেন্টার এলাকা থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত প্রায় পৌনে চার কিলোমিটার রাস্তা ফোর লেনের আওতায় রয়েছে। রাস্তা ফোর লেন হলেও গাংনী ও বাঁশবাড়িয়ার মাঝখানে ঝিনিরপুলটি একেবারেই সরু অবস্থায় রয়েছে। যেখানে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন এলাকার মানুষ। এছাড়া আলমদিনা মাদরাসার সামনের পুরোনো কালভার্টটি মাঝখানে আগের অবস্থানে রেখেই দুই পাশে প্রস্তত করা হয়েছে।
এদিকে গাংনী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের কাছে ও চেংগাড়া বাজারের কাছের দুটি কালভার্ট ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হয়নি। শত বছরের এসব কালভার্টে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এছাড়া চোখতোলার অদূরে নির্মিত একটি কালভার্ট, জোড়পুকুরিয়া-তেরাইলের মাঝখানের একটি কালভার্ট, অলিনগরের মাঠের মাঝখানের একটি কালভার্ট, বাওট ভূটি দোকানের অদূরে নির্মিত কালভার্ট, শুকুরকান্দি-বাওটের মাঝখানের কালভার্টগুলো প্রশস্ত করা হলেও রাস্তার ওপরে রয়েছে কালভার্টের দুপাশের রেলিং।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণসহ সংস্কার প্রকল্পের আওতায় ২৯ কিলোমিটার তিন ভাগে ২৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গাংনীর তেরাইল ডিগ্রি কলেজ থেকে খলিশাকুন্ডি ব্রিজের পূর্বপাশ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার একটি প্যাকেজ। এ প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএম বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও মেসার্স রিমি নির্মাণ সংস্থা। এ প্যাকেজটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৯০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বামন্দী বাজারের অদূরে অস্থায়ী কার্যালয় ও ফিল্ড স্থাপন করেছে।
সেখানে প্রকাশ্যে নিম্নমানের ইট ভেঙে বানানো হয়েছে খোয়া। এ খোয়া ও নিম্নমানের বালু দিয়েই সম্প্রসারিত অংশের ডব্লিউবিএম সম্পন্ন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাতদিন সমানভাবে ও সঠিকভাবে কমপেকশন করা হয়নি মর্মে এলাকার লোকজন বারবার বলার পরও তাতে কর্ণপাত করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, সঠিকভাবে কমপেকশন না হলে ও নিম্নমানের দ্রব্য ব্যবহার হলে রাস্তার স্থায়িত্ব কমে যাবে।
এদিকে মেহেরপুর থেকে তেরাইল বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ পর্যন্ত রাস্তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জহিরুল লিমিটেড। অভিযোগ উঠেছে, রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে কালো পাথর দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে সাদা পাথর। ডব্লিউবিএম ১ নম্বর ইটের খোয়া ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেখানে দেওয়া হয়েছে আমা ইটের (ঠিকভাবে পোড়ানো হয়নি এমন ইট) খোয়া। এছাড়া বালু ও পাথরের সংমিশ্রণ একঃএক দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে দেওয়া হয়েছে পাথর ও বালু একঃচার। নির্মাণ কাজে বাংলাদেশি পিচ ব্যবহারের কথা থাকলেও করা হয়েছে ইরানি পিচ।
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় চলমান সবচেয়ে বড় প্রকল্প এটি। অভিযোগ উঠেছে, কাজ হচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে। নিম্নমানের ইট, বালুর ব্যবহার হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ দেখভালে যান না দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা। এতে স্থানীয় সচেতন অনেকেই কাজ দেখে ক্ষোভে ফুঁসছেন।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলেন, ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে এখনও কাজ বুঝিয়ে দেয়নি। তবে ঠিকাদার রাস্তার পাশে পর্যাপ্ত মাটি না দেওয়ায় দুই পাশ ভেঙে গেছে।
তিনি আরও জানান, রাস্তা হ্যান্ডওভারের তিন বছর পর্যন্ত রাস্তার সব দায়ভার ঠিকাদারের। তারা রাস্তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১২ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২৪
এসআই