নাটোর: একজন সংগ্রামী নারী মমতাজ বেগম। জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে তার কষ্ট।
পরবর্তী সময়ে ঠাঁই মেলে দরিদ্র বাবার বাড়িতে। সেখানেই চলছে তার জীবনযুদ্ধ। সহায়-সম্বলহীন বাবা-মা আর শিশু সন্তানের মুখে এক মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চলছেই। কিন্তু অভাব বা দারিদ্র্য তাকে গ্রাস করে রেখেছে। এ থেকে উত্তরণে প্রাণপণ চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
নিজের প্রয়োজনে একটি সেলাই মেশিনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি কিন্তু কেউ সহায়তার হাত বাড়াননি। ফলে ভাড়ায় সেলাই মেশিন নিয়েই চলছে তার কাজকর্ম। এ মেশিন কেনার সামর্থ্য নেই তার। এ অবস্থায় প্রতিদিন আয় করছেন মাত্র ১০০-১২০ টাকা। যা সংসারের চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। কীভাবে চলবে সংসার আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসা ও ভরণপোষণ? কে দেবে সহায়তা? এই চিন্তাই সারাক্ষণ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
মমতাজ বেগম নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামের মজিবুর রহমানের মেয়ে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে নিজগ্রাম দুর্লভপুর গ্রামের ছেলে রিপন প্রামাণিকের সঙ্গে মমতাজের বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছরের মাথায় তাদের কোলে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। কিন্তু এখানেই বাদে বিপত্তি। তার স্বামীর কন্যা সন্তান পছন্দ না। কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ায় মমতাজের সংসারে শুরু হয় অশান্তি। এজন্য মমতাজের ওপর স্বামী রিপন অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন। বিভিন্ন সময় মারধরসহ দিতেন সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা। পরে এসব কারণে ২০১৭ তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
এরপর থেকে মমতাজ তার মা-বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে দরিদ্র মা বাবার সংসারে গিয়ে শুরু হয় জীবনে আরেকটি অধ্যায়। কারণ তার বাবার বাস্তুভিটা ছাড়া কোনো জমিজমা নেই, নেই কোনো আয়ের উৎসও। তার ওপর বৃদ্ধ বাবা গত সাত বছর ধরে অসুস্থ। তিনি কোনো কাজকর্ম ও চলাচল করতে পারেন না। সপ্তাহে তার প্রায় দেড় হাজার টাকার ওষুধ প্রয়োজন হয়। মায়ের অবস্থাও একই। বাবা মজিবুর রহমান শুধুমাত্র বয়স্ক ভাতা বাবদ প্রতি তিন মাস পরপর মাত্র ১৮শ টাকা করে পান। তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। সংসারে সদস্য বাবা-মা সন্তানসহ চারজন।
দুই বোনের মধ্যে মমতাজ ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে তারা ভালো আছেন। কিন্তু বৃদ্ধ বাবা-মা ও তার শিশু সন্তানকে নিয়ে মমতাজ আছেন বড় বিপাকে। তার শিশু সন্তানের বয়স এখন নয় বছর। সে এখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। তার বাবাও সন্তানের ভরণপোষণের টাকা ঠিকমতো দেন না। আয়ের তেমন উৎস না থাকায় পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে বড়ই বিপদে আছেন মমতাজ। বলা যায়, মমতাজই এখন বাবা-মায়ের হাত আর পা। তাদের কথা বিবেচনা করে পরে আর বিয়েও করেননি মমতাজ। কারণ বিয়ে হলে তার বাবা মাকে দেখার কেউ থাকবে না এমনকি শিশুটিকেও। তাই নিজের এবং শিশু সন্তান আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শুরু হয় সংগ্রামী জীবন।
প্রতিদিন প্রতিবেশীদের বাড়িতে কাজকর্ম করে আয় রোজগার শুরু করেন। কিন্তু তাতে চলে না। পরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিবেশী এক নারীর কাছে সেলাই মেশিনের কাজ শেখেন। এরপর স্থানীয় ময়েন উদ্দিন ফকির নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে মাসিক ৩০০ টাকা হিসেবে সেলাই মেশিন ভাড়া নেন। ওই সেলাই মেশিন দিয়ে লেপের কাভার তৈরি করা শুরু করেন তিনি। গত তিন বছর ধরে ভাড়া করা সেলাই মেশিন দিয়ে কাজ করে আসছেন এ নারী।
মমতাজ জানান, প্রতিদিন ১০-১২টা করে লেপের কাভার তৈরি করেন তিনি। স্থানীয় মহাজন ছিট কাপড় আর সুতা দিয়ে যান। আর প্রতি কাভারে ১০ টাকা করে মজুরি হিসাবে দেন। এতে সারা দিনে তার আয় হয় ১০০-১২০ টাকা। এ আয় দিয়ে সংসার চলে না, যার জন্য বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে থালা-বাসন ধোয়া, গোবর দিয়ে দৈলা (রান্নার জ্বালানি) তৈরি, ধান সেদ্ধসহ নানা কাজকর্ম করেন। তাতে যা পান তা দিয়ে সংসার চলে কোনোমতে।
তিনি আরও জানান, চেয়ারম্যান-মেম্বরদের কাছে ধরনা ধরেও কোনো সাহায্য সহযোগিতা মেলেনি। একটি সেলাই মেশিনের জন্য অনেকের কাছে গিয়েছেন তিনি কিন্তু কেউ পাত্তা দেননি। তাই বাধ্য হয়ে ভাড়ায় সেলাই মেশিন নিয়ে কাজকর্ম করে সংসার চালান। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচসহ সংসারের যাবতীয় খরচ তাকেই বহন করতে হয়। এতে তার হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় তার একটি সেলাই মেশিন বড়ই দরকার। কিন্তু সেটা কেনার সামর্থ্য নেই তার। সরকারি ভাবে যদি কোনো সহযোগিতা পাওয়া যেত, তাহলে খুব ভালো হতো। আর বাবার অভাবের সংসারের জন্য অল্প বয়সে বিয়ে করার কারণে পড়ালেখাও ঠিকমতো করতে পারেননি বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
বৃদ্ধ বাবা মুজিবর রহমান জানান, তার ছেলে সন্তান নেই। মেয়ে মমতাজই তাদের এক মাত্র ভরসা। সে যদি আয় রোজগার না করতেন, তাহলে তাদের না খেয়ে থাকতে হতো। কেননা তার কোনো সম্পত্তি নেই, আয়ের কোনো তার উৎস নেই, তিনি নিজেও কোনো কর্ম করতে পারেন না, তার স্ত্রীর শরীরটাও ভালো না। বয়স্ক ভাতার যে টাকা পান, তা দিয়ে তার চলে না। খুবই কষ্টে আছেন তারা।
প্রতিবেশী আব্দুল মান্নান বলেন, সত্যিই মমতাজ একজন অসহায় মেয়ে। বৃদ্ধ-বাবা মা ও শিশু সন্তানকে নিয়ে খুব মানবেতর জীবনযাপন করেন। তাদের কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত আর বিয়েও আর করেনি মমতাজ। অভাব আর কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঠিকমতো খেতেও পারে না মমতাজ। ভিটেমাটি ছাড়া তাদের কিছু নেই। সহায় সম্বলহীন এ পরিবারটির প্রতি সরকারি সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন।
একই কথা জানালেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য উৎপল কুমার মৈত্রসহ আরও অনেকে।
প্রতিবেশী ময়েন উদ্দিন বলেন, মমতাজের অবস্থা দেখে আমার সেলাই মেশিন মাত্র ৩০০ টাকা মাসিক ভাড়ায় দিয়েছি। কোনো মাসে টাকা দেন, কোনো মাসে দিতে পারেন না। পরিস্থিতি দেখে টাকার জন্য কোনো চাপ দেই না। কারণ মমতাজ আসলেই একজন অসহায় নারী। সে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। তাকে সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন। অনেকেই উপজেলা বা বিভিন্ন সংস্থা থেকে সেলাই মেশিন বিতরণ করেন। অথচ মমতাজদের মতো অসহায়দের কেউ দেখে না।
এ ব্যাপারে নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেওয়ান আকরামুল হক বাংলানিউজকে জানান, মমতাজের বিষয়টি খোঁজখবর নেওয়া হবে। পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে সহযোগিতা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪
এসআরএস