ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বগুড়ায় সোনালি আঁশে রঙিন স্বপ্ন কৃষকের

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০২৪
বগুড়ায় সোনালি আঁশে রঙিন স্বপ্ন কৃষকের

বগুড়া: সকাল গড়িয়ে দুপুর। রোদ তখন খাঁ খাঁ করছিল।

পানির মধ্যে কাজ করলেও তাপে ঘাম হচ্ছিল প্রচুর, টপ টপ করে ঘাম পানিতেই পড়ছিল। কিন্তু তাদের লেশমাত্র খেয়াল নেই সেদিকে। পাটখড়ি থেকে সোনালি আঁশ আলাদা করতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন কয়েকজন চাষি।

বগুড়া জেলার চাষিরা এখনও পর্যন্ত পাটের ভালো দামই পাচ্ছেন। তবে জেলার বিভিন্ন বাজারে পাটের আমদানি বেশি হওয়ায় গেল এক সপ্তাহের ব্যবধানে জাত ভেদে মণ প্রতি পাটের দাম ১০০-২০০ টাকা কমেছে।

সোমবার (০৭ অক্টোবর) বগুড়ার সদর, সারিয়াকান্দি ও গাবতলা উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, পাট নিয়ে কৃষকদের নানান কর্মব্যস্ততা।

জানা গেছে, গেল কয়েক বছরের মধ্যে কখনো লাভ আবার কখনো লোকসানের মধ্য দিয়ে পাট চাষ করছেন চাষিরা। সুদিন ফেরার আশায় বার বার আবাদ তালিকায় পরিবর্তন এনেছেন। কমিয়েছেন চাষের জমি। কিন্তু এরপরও হার মানেননি তারা। নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করে হাজারো কৃষক পাট চাষ অব্যাহত রেখেছেন। এ বছর জেলার ১২টি উপজেলায় আট হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে মেস্তা, দেশি ও কেনাপ জাতের পাট চাষ হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত কাটা হয়েছে মোট সাত হাজার ৬০৯ হেক্টর জমির পাট।

জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, জাগ দেওয়া পাট বৈঠার নিচে ফেলে পিটিয়ে হাতের কৌশলে পাটখড়ি ও আঁশ আলাদা করায় ব্যস্ত চাষিরা।

এরপর সেই পাটখড়ি ও আঁশ পানির কিনারা ঘেঁষে কিছুটা ওপরের দিকে আলাদা করে রাখছেন তারা। পরে আঁশগুলো নিয়ে শুকানোর জন্য সারিবদ্ধভাবে নেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। একই ভাবে পাটখড়ি বিশেষ কায়দায় খাড়া করে শুকানো হচ্ছিল। পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও এ কাজ করতে দেখা গেল। এভাবে কৃষাণ-কৃষাণী মিলেমিশে সোনালি স্বপ্ন ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা।

বগুড়ার ১২টি উপজেলার মধ্যে যমুনা বেষ্টিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি জমিতে পাট চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া জেলার নয়টি উপজেলায় কমবেশি পাট চাষ করা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বন্যার পানির কারণে এ বছর বগুড়া জেলার চাষিরা বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম জমিতে পাট লাগাতে পেরেছেন। এ জেলার চাষিরা এ পর্যন্ত তুলনামূলক পাটের ভালো দাম পেলেও চরাঞ্চলের ফসল কিছুটা বিনষ্ট হওয়ায় চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ তাদের। এর মধ্যে জেলার বিভিন্ন বাজারে পাটের আমদানি বেশি হওয়ায় গেল এক সপ্তাহের ব্যবধানে জাতভেদে মণ প্রতি পাটের দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা কমেছে।

সারিয়াকান্দি উপজেলার পাটচাষি এস আব্দুল্লাহ শাহী, তৈমুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, যমুনা নদীর চরাঞ্চলে বেশিরভাগ জমিতে পাট চাষ করা হয়। জমিভেদে পাট চাষে ব্যয় নির্ণয় হয়ে থাকে। পাটের ক্রেতা নির্দিষ্ট। অন্য ফসল যেমন অনেক শ্রেণির ক্রেতা কিনে থাকেন, পাটের ক্ষেত্রে তেমন ক্রেতা নেই। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জীবিকার তাগিদে দ্রুত পাট বিক্রি করতেও বাধ্য। হয়তো পাটের ক্রেতারা এ সুযোগটা নেন। এ কারণে চাষিরা পাটের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। পাটের দাম আরও বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

তারা বলেন, পাট চাষাবাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবিঘা জমির বিপরীতে সর্বোচ্চ আট থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। দিনে একজন কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় ৫০০-৬০০ টাকায়। গেল সপ্তাহে উৎপাদিত দেশি ও তোষা পাট মণ প্রতি ২৯০০-৩৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আমদানি বেশি হওয়ায় সেই পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৮০০-২৯০০ টাকা দরে। তবে ব্যবসায়ীদের কাছে চরে উৎপাদিত পাটের বাড়তি চাহিদা থাকায় ভালো দাম পাওয়া যায় বলেও মন্তব্য করেন তারা।

গাবতলী উপজেলার চাষি মিজুনুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, এ বছর তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। ক্রেতারা অনেকটা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছে মতো দাম কমিয়ে দেন, আবার বাড়ান। তার চাষাবাদের জমিতে এবার বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে নয় থেকে ১২ মণ। তার চাষাবাদের সর্বোচ্চ ভালো মানের পাট আঁশ প্রতি মণ ৩২০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। আর ক্রেতার চোখে পাটের আঁশে একটু সমস্যা মনে হলেই প্রতি মণ একই পাট ২৮৫০ থেকে ২৯০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন চাষিরা।

সদর উপজেলার পাট চাষি হান্নান মিয়া বাংলানিউজকে জানান, এ বছর তিনি ছয় বিঘা জমিতে পাট আবাদ করেছিলেন। প্রতি বিঘায় নয় মণ ফলন হয়েছে। পাঁচ বিঘা জমির পাট তিন হাজার ১০০ থেকে তিন হাজার ৩০০ টাকা মণ বিক্রি করে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা পেয়েছেন তিনি। ছয় বিঘা জমির পাট আবাদ করতে তার খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। পাট আবাদের প্রথম দিকে বৃষ্টি না থাকায় সেচ দিয়ে পাট বপন করতে হয় তাকে। এখনো কিছু পাট কাটা বাকি আছে। পাটের ফলন আর দামে  অনেক খুশি তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বগুড়া জেলায় এবার ১০ হাজার ১৭৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। চাষাবাদ হয়েছে আট হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে। বগুড়ায় যমুনা ও বাঙালি নদীতে পানি বাড়ায় এ বছর পাটচাষিরা কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। বন্যায় ক্ষতির পরও জেলায় এ পর্যন্ত সাত হাজার ৬০৯ হেক্টর জমির পাট কেটেছেন চাষিরা। এর মধ্যে বেশির ভাগ পাট চাষ করা হয় যমুনা বেষ্টিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায়।
নদীর তীরবর্তী ও চর এলাকায় উৎপাদিত পাটের মান অত্যন্ত ভালো হয়। প্রতি বছর এ জেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা বেশি নির্ণয় করা হলেও ক্ষতির কারণে তা পূর্ণ হয় না। সেদিক থেকে কৃষকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী দামটাও পান না।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২৪
কেইউএ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।