খুলনা: কুয়াশায় মোড়ানো অগ্রাহয়নের সকাল। পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে সূর্য।
কাজের ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ২৬ বছর ধরে গাছ কাটি। মাঝে এক বছর অসুস্থতার জন্য গাছ কাটতি পারিনি। আগে একটি খেজুর গাছ কেটে ২৫ টাকা পেতাম। আর এখন প্রতিটি খেজুর গাছে ৩০০ টাকা নিই। এছাড়া অনেকের গাছ হাড়িতে নিই। এ বছর একটি বাগানের ৭০টা গাছ আমি ৯ হাজার টাকা দিয়ে নিয়েছি। কোনো গাছে প্রতিদিন এক হাড়ি রস হয়, আবার কোনো গাছে মোটেও হয় না। এক সিজনে একটি গাছে ১৫ থেকে ১৭ ভাঁড় রসও হয়। আবার কিছু গাছে সারা সিজনে এক থেকে দুই ভাঁড় রস হয়। আগের তুলনায় এখন রস কম হয়, গাছও অনেক কমে গেছে। ১০টি গাছ কাটলে দুই-তিনটিতে রস পাওয়া যায় না।
রস গাছতলা থেকে ২০০ টাকা ভাঁড় বিক্রি হয়। রস জ্বালায়ে গুড় করেও বিক্রি করি। গাছ কেটে কষ্টে সংসার চলে। দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি। ১৫ দিন পরে চাঁচ দিতে হয়। এক সপ্তাহ পরে খিল দিচ্ছি। খেজুর রসের চাহিদা যে পরিমাণ সে পরিমাণ রস দিতে পারি না।
ডুমুরিয়ার পিঁপড়ামারি এলাকার বাসিন্দা মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের অন্তত ২০টি খেজুর গাছে রয়েছে। গাছির অভাবে গাছ কাটা সম্ভব হচ্ছে না। এলাকায় খেজুর গাছ ও গাছি কমে গেছে। তবু দিন দিন খেজুর রসের চাহিদা বাড়ছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলার মঠ ফুলতলা গ্রামের বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর অন্তত ত্রিশটি খেজুর গাছ কাটছি। রস সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আগে তো অনেক লোকজন এলাকায় খেজুর গাছ কাটতো। এখন হাতে গোনা অল্প কয়েকজন কাটে। রস দিয়ে গুড় তৈরি করি নিজেরা কিছু খাই, বাদবাকি বিক্রি করি।
দাকোপের ছিটাবুনিয়া এলাকার ননী গোপাল রায় বলেন, আগে খেজুর গাছ কাটতাম। এখন আর কাটি না। এলাকায় আগের মতো গাছ নেই। যা আছে তাতে রস কম হয়। তবে এলাকায় রসের চাহিদা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর শীত মৌসুম শুরুর পর গ্রাম থেকে শহরে অনেক গাছি রস বিক্রি করতে আসতো। কিন্তু এবার তাদের দেখা মেলেনি। গাছির অভাব আর গাছ কেটে সাবাড় করায় খেজুর রস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিপুল চাহিদা থাকলেও মিলছে না খেজুরের গুড়। এখনো বিভিন্ন এলাকায় অনেক খেজুরগাছ থাকলেও পরিচর্যার অভাবে সেগুলো মরে যাচ্ছে। সঙ্গে গাছির অভাবে রস সংগ্রহ করতে পারেন না অনেকে। এ ছাড়া এখন যেসব গাছ আছে, তাতেও পর্যাপ্ত রস মিলছে না। খেজুর গাছ ব্যবহার হচ্ছে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে। এ কারণে কমে যেতে বসেছে খেজুর গাছ।
খুলনার সাংস্কৃতিক কর্মী হারুন-অর-রশীদ খান বলেন, একসময় খেজুরের রস ও গুড়ের চলন ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। বর্তমানে শহরে এর চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে খেজুর গাছের পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এছাড়া রস তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধি এবং গাছিদের পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক না পাওয়ায়, অনেকেই এই পেশা বদলে ফেলেছেন। গাছির অভাবে এসব অঞ্চলের বহু খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এক পর্যায়ে এই গাছগুলো কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে যায়। এভাবে সময়ের ব্যবধানে খেজুর গাছ উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রক্রিয়াজাত চিনির ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় এবং শহুরে জীবনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় খেজুরের রস ও গুড় এক বিশেষ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। তাছাড়া শীতকালীন পিঠাপুলি, পায়েসসহ রকমারি খাবার তৈরিতে খেজুর রস ও গুড়ের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। তবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের এই চাহিদা ও আবেগকে পুঁজি করে কেমিকেলযুক্ত ভেজাল রস ও গুড় বাজারজাত করে মানুষের চরম ক্ষতি করছে। গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে খেজুর গাছ বৃদ্ধি, গাছিদের ভর্তুকি প্রদান, রস ও গুড় সংরক্ষণ এবং ভেজাল প্রতিরোধের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
কৃষি সম্প্রসারণ খুলনার উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, দিন দিন খেজুর গাছ কমছে। যে কারণে আগের মতো রস ও গুড়ের দেখা মিলছে না। মূলত ইটভাটা গিলে খাচ্ছে খেজুর গাছ। খেজুর গাছ প্রাকৃতিক এক অমূল্য সম্পদ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খেজুর গাছ রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। যে কারণে আমরা প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির সময় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তাল ও খেজুর গাছ রোপণ করে থাকি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০২৪
এমআরএম/এমজে