ফেনী: ছেলেটি তখনো কিশোর, মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হয়নি। সেই বয়সেই সইতে হয় ‘আয়না ঘরের’ মতো অন্ধকার প্রকোষ্ঠের নির্মম অত্যাচার, আট মাসের জেলজীবন।
কৈশোরে এমন নির্যাতনের শিকার তরুণটির নাম আবু নাসিম মো. ওবায়দুল্লাহ। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতীর করতাম গ্রামের বাসিন্দা তিনি।
ঘটনার শুরু ২০২২ সালের শেষের দিকে। তখন নাসিম পড়তেন গুনবতী ফাজিল (স্নাতক) মাদ্রাসায়। দাখিল (এসএসসি) পরীক্ষা দিয়েছেন সবে। ভারতে বিজেপির মুখপাত্র নুপুর শর্মা ইসলামের নবী (সা.)-কে কটূক্তি করার কারণে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার গুনবতী বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল হয়।
সেই মিছিল শেষে প্রতিবাদ স্বরূপ ভারতের একটি প্রতীকী পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেই ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন নাসিম। তারপরই কিশোর নাসিমের ওপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টিম রোলার।
সে বছরের ২৮ নভেম্বর দাখিল পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার দিন ফেনী থেকে গ্রামে গেলে গুনবতী বাজার থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ আবু নাসিম মো. ওবায়দুল্লাহকে তুলে নিয়ে যায়।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় নাসিম জানান, তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে দুইদিন রাখা হয় চৌদ্দগ্রাম থানা হাজতে। এরপর নেওয়া হয় ঢাকায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে। সেখানে রাখা হয় পাঁচ দিন, যা তার স্বজনদের জানানো হয়নি।
নাসিমের ভাষ্যে, প্রথমদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, তিনি জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত কি না। পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছেন কি না। অস্ত্র ব্যবসায়ী কি না।
নাসিম বলেন, ‘যেহেতু আমি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না তাই কিছু বলতেও পারিনি। তখন ঘরের মেঝেতে শুইয়ে এলোপাতাড়ি লাথি দিতে থাকতো কিছু মানুষ। এক পর্যায়ে বলা হয়েছিল, গায়ে লবণ-মরিচ মেখে দেবে। যদিও এটা বলেছিল আমাকে ভয় দেখানোর জন্য যাতে আমি তাদের কথা মতো সব বলি। ’
পরবর্তী চারদিন প্রতিদিন যমটুপি (যে টুপি পরালে চোখ-মুখ ঢাকা থাকতো) পরিয়ে নাসিমকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখান থেকে ভেসে আসতো চিৎকার, কান্নার শব্দ।
পানি চাইলে দেওয়া হতো মূত্র
নাসিম বলেন, ‘অন্ধকার সেই ঘরে থাকা লোকগুলো এলোপাতাড়ি যখন নির্যাতন করতো তখন খুব ক্লান্ত লাগতো। মরে যেতে ইচ্ছে করতো। টানা দুই তিন ঘণ্টা মারতো। পানি চাইলে বোতলে করে এনে দেওয়া হতো মানুষের মূত্র৷ খাবার হিসেবে দেওয়া হতো শক্ত শুকনো রুটি ও আলু ভাজি।
নাসিমের দাবি, মারার সময় ওরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতো তখন হিন্দিতে কথা বলতো।
মাথায় গরম পানি দেওয়া হতো
নির্যাতনের বর্ণনায় নাসিম বলেন, প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পর যমটুপি পরিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে একাধারে দুই থেকে তিন ঘণ্টা চলতো অত্যাচার। পেটানো হতো ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে। দুই তিন ঘণ্টা ঝুলিয়ে পেটানোর পর আধা ঘণ্টার মত অল্প অল্প করে গরম পানি দেওয়া হতো মাথায়। সেকি অসহনীয় অত্যাচার। যমটুপি পরানো থাকায় কিছুই দেখা যেতো না।
দেওয়া হতো ইলেকট্রিক শকও
নাসিম জানান, শেষদিন দুইবার ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয় তাকে। তবুও যখন কিছু বলাতে পারেনি। দুইবারের ইলেকট্রিক শকে অজ্ঞান হয়ে যান নাসিম। শেষ পর্যায়ে নির্যাতনকারীরা সিদ্ধান্ত নেয় তাকে আদালতে হস্তান্তর করার।
অজ্ঞাত স্থানে এভাবে পাঁচদিন অত্যাচারের পর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাসিমের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ডিএমপির সিটিটিসির সাইবার ইন্টেলিজেন্স টিমের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) এম আব্দুল্লাহিল মারুফ বাদী হয়ে ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মামলাটি করেন। যেখানে নাসিমের বিরুদ্ধে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ ব্যবহার করে ‘রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী পোস্ট’ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। ওই মামলায় তাকে ঢাকা সিএমএম আদালতে তোলা হয় ৫ ডিসেম্বর।
এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত বয়স কম দেখে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে আর তেমন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ হয়নি। তারপর থেকে শুরু হয় জেল জীবন।
আট মাস কারাভোগ
নাসিমকে এরপর পাঠানো হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে। তাকে জেল খাটতে হয় আট মাস। কারাগারের মধ্যে তেমন নির্যাতন না হলেও জীবন থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবান সময়গুলো।
দমে যাননি নাসিম ওবায়দুল্লাহ
এত অত্যাচার-নির্যাতনের পরেও কৈশোর পেরিয়ে আসা নাসিম দমে যাননি। অংশ নেন ২৪’র ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। ঢাকার রাজপথে নেমেছিলেন আন্দোলনে। সর্বশেষ ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালের আন্দোলনেও গুলিবিদ্ধ হন। এখনো সেই গুলির চিহ্ন রয়েছে হাতে।
মামলার খরচ চালাতে গিয়ে নিজের বাড়িও বিক্রি করতে হয়েছে
নাসিমের বাবা স্থানীয় গুনবতী আল ফারাবী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাইফুদ্দিন মাহমুদ বলেন, জেলে থাকতে প্রতিমাসে ছেলের জন্য টাকা করে পাঠাতে হতো। শিক্ষকতার চাকরির বেতনের অর্ধেকের বেশি চলে যেতো সেখানে। সংসার চলতো না। শেষ পর্যন্ত ছেলের মামলা পরিচালনা ও নিয়মিত ঢাকায় আসা যাওয়ার খরচ বহন করতে শেষ সম্বল একটি ফ্ল্যাটও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। সেই কষাঘাতে এখনো ঋণগ্রস্ত। থাকতে হচ্ছে ভাড়া ঘরে।
অবশেষে মুক্তি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ২৯ নভেম্বর আদালত বেকসুর খালাস দেয় নাসিম ওবায়দুল্লাহকে। মুক্তি মিললেও পড়ালেখা আর হয়নি। হারিয়েছে জীবনের ছন্দ। এখনো সারাক্ষণ একটা ট্রমায় ভুগছেন নাসিম। সেসব দিন মনে হলেই আঁতকে ওঠেন তিনি।
নাসিমের মা রাহেনা বেগম বলেন, ছেলের গায়ে এখনো অত্যাচারের চিহ্ন রয়েছে। ছেলে মাঝে মধ্যেই ঘুম থেকে আঁতকে উঠে বলে ‘আমায় মুক্তি দাও আর পারি না’। ছেলে এখন পড়তে চায়। কিন্তু মাথায় কিছুই ঢোকে না। ছেলেটা কেমন যেন আনমনে থাকে। অনেকটা মানসিক রোগীর মতে হয়ে গেছে আমার সন্তানটা।
ছেলের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো ফেরত চান মা। নাসিমের ওপর নির্মম অত্যাচারেরও বিচারও চান তার জননী।
যা বলেছেন আইনজীবী
নাসিমের আইনজীবী লিগ্যাল সলিউশন চেম্বারের (এলএসসি) হেড অব চেম্বারস ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল বলেন, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে মাধ্যমে আমরা নাসিমকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। তার বিরুদ্ধে চরম নির্যাতন হয়েছে, সামান্য একটা ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে এই নির্যাতন চরম অন্যায্য।
তিনি বলেন, ১৬ বছরের একটা শিশুকে মিথ্যা মামলা দিয়ে আট মাস জেলে রাখা হয়েছে-এটি মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। এই মামলাটি নতুন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রায় হয়েছে। বিজ্ঞ আদালতে প্রমাণ হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অসত্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২৪
এসএইচডি/এসএএইচ/