মেহেরপুর: অত্যাচার ও পরকীয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে ভাড়াটে খুনি দিয়ে স্বামী আলমগীর হোসেনকে (আলম) কুপিয়ে হত্যা করার পর এ ঘটনায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা করেন চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী স্ত্রী বেদানা খাতুন।
হত্যার তিন মাস পরে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে মামলার বাদীসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর তারা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দায়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মেহেরপুর পুলিশ সুপার মাকসুদা আকতার খানম বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের প্রেসনোট দিয়ে এ তথ্য জানান।
গত তিন মাস ধরে চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি নিয়ে পুলিশ গভীরভাবে তদন্ত করেন। তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আটকদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়ার পর বুধবার দিবাগত রাতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলেন- হত্যার পরিকল্পনাকারী এবং অর্থ যোগানদাতা মামলার বাদী নিহতের স্ত্রী মোছা. বেদেনা খাতুন (৩৭), হত্যার আরেক পরিকল্পনাকারী ও অর্থের যোগানদাতা নিহতের শাশুড়ি মো. শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী শাহিনুর বেগম (৫৫), হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারী তারানগর গ্রামের মো. সেকের আলী শেখের ছেলে হামিদুল হামদু (৪৫) ও একই গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে মিন্টু ধুলো পেটু (৪০)।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পরস্পর যোগসাজশে আলমকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে সম্মতি দেন। পরে বৃহস্পতিবার আদালতে তিনজন ১৬৪ ধারায় হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। এসময় তাদের জেল হাজতে পাঠানো হয়।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট দিবাগত রাতে মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের তারানগর গ্রামের আগবত আলীর মেজ ছেলে আলমগীর হোসেন আলমকে (৪৪) নিজ ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
১০ই আগস্ট হত্যার শিকার আলমের স্ত্রী মুজিবনগর থানায় ৩০২/৩৪( বাংলাদেশ পেনাল কোডে) ধারায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর -২, তারিখ ১০ আগস্ট ২০২৪ ইং। মামলাটি দায়েরের পর থেকেই পুলিশ এবং সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল কাজ করে।
প্রেসনোটে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট দিবাগত রাত ১১টার দিকে মুজিবনগর উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী তারানগর গ্রামের মো. আগবত আলীর মেঝ ছেলে আলমগীর ওরফে আলমকে দুর্বৃত্তরা ঘুমন্ত অবস্থায় এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে।
এ ঘটনায় নিহত আলমগীর হোসেন ওরফে আলমের স্ত্রী বেদেনা খাতুন মুজিবনগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর ০২/১১৬, তারিখ: ১০/০৮/২০২৪, ধারা: ৩০২/৩৪ পেনাল কোড। বর্তমানে মামলাটি আদালতে তদন্তাধীন।
২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মুজিবনগর থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। যার মধ্যে তিনজন আসামি স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এদের মধ্যে মামলার বাদী বেদেনা খাতুন, শাহিনুর বেগম এবং হামিদুল ওরফে হামদু হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
প্রেসনোটে আরও বলা হয়, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, বাদী বেদেনা খাতুনের সঙ্গে তার স্বামী নিহত আলমের ২০ বছরের সংসারে তিনজন সন্তান রয়েছে। বাদীর ভরণ-পোষণ না দেওয়া, পর নারীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং মাদকাসক্তির কারণে বাদীর সঙ্গে স্বামী আলমের দাম্পত্য কলহ প্রকট আকার ধারণ করে। বেদেনা খাতুন এবং তার মা শাহিনুর বেগম (নিহতের শাশুড়ি) আলমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। গরু বিক্রির এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে তারা হামিদুল ওরফে হামদু এবং ধলো ওরফে মিন্টু ওরফে পেটুকে ভাড়া করেন।
হত্যার দিন ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট দিবাগত রাতে আলমকে রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলে সে তার কক্ষে রাত ৯টার সময় ঘুমিয়ে পড়েন। পাশের কক্ষে বাদী তার সন্তানদের নিয়ে ঘুমাতে যান। পূর্ব পরিকল্পনা মতে রাত অনুমান ১১টার দিকে ভাড়াটে খুনিদের ডেকে আনেন। রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে ভাড়াটে খুনি হামিদুল ওরফে হামদু এবং ধুলো ওরফে মিন্টু ধারালো দা দিয়ে আলমের মাথা ও ঘাড়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘরের সিটকিনি লাগিয়ে চলে যান। স্বামীর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর রাত ১২টার সময় বাদী তার মেয়েকে নিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার নাটক সাজিয়ে তার আত্মীয় ও আশপাশের লোকজনকে জড়ো করে।
এ ঘটনায় স্ত্রী বেদেনা খাতুন নিজেই বাদী হয়ে মুজিবনগর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
যেভাবে ঘুরে যায় মামলা তদন্তের মোড়:
হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে বেদেনা খাতুন তার পালিত একটি গরু এক লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এই টাকার কথা জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর না দিয়ে আমতা আমতা করে এলোমেলো উত্তর দিতে থাকেন।
এছাড়া মামলার বাদী তার স্বামী হত্যার বিচারের দাবিকে প্রাধান্য কম দিয়ে সর্বদা তার স্বামীর বিরুদ্ধে নানা রকম অপবাদ-অভিযোগ দিতে থাকেন।
পাশের রুমেই হত্যার ঘটনা ঘটলেও মামলা তদন্তে বাদিনী শুরু থেকেই তথ্য দিয়ে সহায়তা না করে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলার চেষ্টা করতে থাকেন।
এসব কারণে প্রথম থেকেই তদন্ত কর্মকর্তার বাদীর ওপর সন্দেহ বাড়তে থাকে এবং তদন্তে তারই সত্যতা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০২৫
আরএ