ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাগেরহাটের সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার এবং খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ১৭ ও ১৮তম সাক্ষী।
তারা হলেন, বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার রাড়অপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার বেপারী ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলার তেলিগাতি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিবর খাঁ।
বুধবার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন তারা। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন আসামি সিরাজ মাস্টারের রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান এবং খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারের আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন।
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৯তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
সাক্ষ্যে ১৭তম সাক্ষী আব্দুল জব্বার বেপারী বলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২৭/২৮ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তেলিগাতি ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে আষাঢ় মাসের শেষের দিকে বাড়ি ফেরেন।
বাড়িতে ফেরার পরদিন সকালে ঘাস খাওয়াতে গোয়ালের তিনটি গরু নিয়ে বাড়ির পাশে মাঠে আসেন। মাঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরামসহ অন্য রাজাকাররা তাকে ঘিরে ধরেন এবং গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলেন।
পরে রাজাকাররা তিনটি গরুসহ তাকে দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে রাজাকাররা অমানুষিক নির্যাতন করে। পরবর্তীতে এক নিকটাত্মীয়ের মধ্যস্থতায় বাগেরহাট মহকুমার রাজাকার কমান্ডার রজব আলী ফকিরের নির্দেশে দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার খান আকরাম তাকে ছেড়ে দেন।
সাক্ষী বলেন, রাজাকার ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তার অবস্থা ছিল খুবই গুরুতর। ছাড়া পাওয়ার পর সেখান থেকে তাকে সরাসরি বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে প্রায় একমাস চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি।
এরপর ১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির কারণে অপারেশন সমাপ্ত না করেই মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরে আসতে হয়। কিন্তু পরদিন রাজাকাররা শাখারিকাঠি বাজারে আক্রমণ চালিয়ে ৪০/৪২ জনকে হত্যা করে রাজাকাররা। এ হত্যাকাণ্ডে রাজাকার সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনসহ আরো অনেক রাজাকার ছিল বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন আব্দুল জব্বার বেপারী।
প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষী আব্দুল মজিবর খাঁ প্রায় একই ঘটনার কথা উল্লেখ করেন সাক্ষ্যে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। তিনিও স্থানীয় তেলিগাতি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বর্তমানে তার আনুমানিক বয়স ৬২ বছর।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও ১৬ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন দিলীপ দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, শহীদজায়া কমলা রানী চক্রবর্তী, তপন কুমার দাস, শহীদপুত্র অরুণ দাস, শহীদপুত্র নন্দলাল দাস, নিমাই চন্দ্র দাস, শহীদপুত্র আনন্দ লাল দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজর আহমেদ, শহীদপুত্র সোবহান শেখ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব নকিব এবং সোলায়মান সরদার।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন।
গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজাকার কমান্ডার ‘বাগেরহাটের কসাই’ বলে কুখ্যাত সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং তার দুই সহযোগী আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খাঁনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে ৩টি করে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের শাঁখারিকাঠি বাজার, রনজিৎপুর, ডাকরা ও কান্দাপাড়া গণহত্যাসহ ৮ শতাধিক মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন। অন্যদিকে ৩০ সেপ্টেম্বর ও ২০ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের পক্ষে তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর সরোয়ার হোসেন এবং শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের পক্ষে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল হাসান।
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিসে প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন ও শেখ মুশফিক কবির তাদের বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
তদন্ত চূড়ান্ত করে গত বছরের ২৫ আগস্ট এ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করেন তদন্ত সংস্থা। তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত দল দীর্ঘ তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে এ চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রসিকিউশন এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
বাগেরহাটের এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ ৯টি ভলিউমে ৫ খণ্ডে কেস ডায়েরি করে অভিযোগ দাখিল করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ৯টি খণ্ডে মোট ৮শ’ ৪৪ পৃষ্ঠার তদন্তের ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ৬৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন তদন্ত সংস্থা।
ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছরের ১০ জুন এ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১১ জুন আব্দুল লতিফ তালুকদার, ১৯ জুন আকরাম হোসেন খাঁন ও ২১ জুলাই সিরাজ মাস্টারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
তাদেরকে সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় এ তিনজনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫