ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

‘শেষ পর্যন্ত ওনাদেরই বসতে হবে’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫
‘শেষ পর্যন্ত ওনাদেরই বসতে হবে’ ছবি: নাজমুল হাসান/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘সহিংস রাজনীতি অবরুদ্ধ দেশ: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা দেশের চলমান অচলাবস্থার অবসানে শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘ওনাদের মধ্যে বিশ্বাস নেই, সম্মান নেই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওনাদের বসতেই হবে, সংলাপ করতেই হবে। ’

রোববার (০১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর গুলশানের হোটেল লেকশোরে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে রিজিওনাল টেরোরিস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (রাত্রি)। রাত্রির নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সিকদারের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক জিনাত হুদা।

সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, রাজনীতিকে কখনোই সহিংস বলবো না। অপরাজনীতির মাধ্যমে একে সহিংস করা হচ্ছে। দেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর প্রয়াসেই এগুলো করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারকে অত্যন্ত শক্তভাবে মোকাবেলা করতে হবে। কারণ, দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় খুবই কম। জনগণকে সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে কতিপয় দুর্বৃত্তকে দমন করা সম্ভব।

তিনি বলেন, প্রত্যেক ব্যবসায়ীর উচিত হবে তার নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখা। এটি হবে অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রাষ্ট্রবিরোধী কাজ যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে বিদ্যুৎ-গ্যাস বন্ধের দরকার হবে না।  

সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কীসের পরীক্ষা, কীসের কী- তার কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত।  

বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, একজন অবরোধ ডাকতে পারেন। এটি তার অধিকার। তেমনি আমার পণ্য আমি বাজারে নিয়ে যাবো, পণ্যের ট্রাক চট্টগ্রামে নিয়ে যাবো। এটিও আমার অধিকার।

সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, এখন রাজনীনৈতিক অস্থিরতায় সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজা হচ্ছে। এদেশের মানুষ এসব খারাপ অবস্থা দ্রুত ভুলে যায়। ওনাদের (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) মধ্যে বিশ্বাস নেই, সম্মান নেই। শেষ পর্যন্ত ওনাদের বসতেই হবে, সংলাপ করতেই হবে।  

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি বলেন, যখন হেফাজতের ঘটনা ঘটলো, তখন শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন যেন বিষয়টির সমাধান হয়। খালেদা জিয়া ওই সময় শেখ হাসিনাকে আমল দেননি। আবার বিগত এক বছর খালেদা জিয়া সমাধান চেয়েছেন। আসলে দু’দলের মধ্যে অবিশ্বাসের যে জায়গা রয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে উদ্যোগী হতে হবে।
 
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, বিবাদমান দু’পক্ষের মধ্যে কীভাবে কনফিডেন্স বিল্ডিং করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেউ আমাদের হাতে ধরে সমাধান করে দেবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে।  

বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদুল আজিম বলেন, আমাদের জন্য সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রপ্তানিমুখী শিল্প নিয়ে সময়ের সঙ্গে আমাদের পাল্লা দিতে হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।

সংসদ সদস্য নাইমুর রহমান দুর্জয় বলেন, যখনই দেশের ব্যবসা এগিয়ে যায় তখনই এ ধরনের কাজ শুরু হয়। বিএনপি নেত্রী দেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক রাজনীতি করছেন। সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন তিনি। এক সময় জেলে থেকে রাজনীতিকরা ইতিবাচক রাজনীতি করেছেন। এখন সেই রাজনীতি থেকে সরে আসা হয়েছে। এখানে চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে কেউ খেলতে না আসে।

অ্যাডভোকেট স ম রেজাউল করিম বলেন, অপরাধগুলোকে আড়াল করার কারণেই দেশের এ অবস্থা। ক্ষমতায় থাকলে গ্রেনেড মারবো, বাইরে থাকলে পেট্রোল মারবো -এটা চলতে দেওয়া যায় না। আইনের কঠোর প্রয়োগ হতে হবে।     
 
ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুলিশকে মেরে থেঁতলে দেওয়া হচ্ছে। এটি রাজনীতি নয়, জঙ্গিবাদ।  

মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষ যদি না থাকে তাহলে কার জন্য রাজনীতি। তাই মানুষ মারার এই অপরাজনীতি বন্ধ করুন। জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর হতে না পারলে পরিণতি ভালো হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, পেট্রোল বোমাকে কোনো ছাড় নয়, সন্ত্রাসকে কোনো ছাড় নয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এ ধরনের খারাপ অবস্থার মধ্যে কখনো পড়েনি। যারা এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে তাদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, বিশ্ব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল তখন তারা স্পষ্টই বলেছিল, হয় আপনি সন্ত্রাসের পক্ষে থাকবেন, নতুবা আমার পক্ষে থাকবেন। এর বাইরে কোনো অবস্থান নেই। আজ বাংলাদেশের অবস্থাও সে রকম হয়েছে। সন্ত্রাসের পক্ষ শক্তি আর বিরোধী শক্তি। মাঝামাঝি কোনো অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই।
 
সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের বলেন, সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, কারণ দু’পক্ষেই জনসমর্থন রয়েছে। যেসব সন্ত্রাস চলছে সেসবের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। এদের নির্মূল করতে হলে ওই সব জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে হবে। তবে এটি সমাধান নয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে এগোতে হবে। শান্তিপূর্ণ পথে মানুষ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ না করতে পারলে সহিংস পথে যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, আমরা সংলাপ চাই। তবে তার আগে পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস বন্ধ চাই। সন্ত্রাসের কাছে মাথা নোয়াতে জানে না এদেশের জনগণ।

তিনি বলেন, যারা ১৫ লাখ ছেলেমেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাদের সঙ্গে সংলাপ নয়। চিত্ত শুদ্ধ হয়ে আসুন, তাহলে আলোচনা হবে। পাঁচ কোটি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, ৩০ লাখ ছেলে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। এদের পথ রুদ্ধ করতেই এই সন্ত্রাস।

দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সরওয়ার বলেন, রাজনীতি যদি হয় শিক্ষা ধ্বংস করা, তাহলে সেই রাজনীতির দরকার নেই। একে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। আপনার (খালেদা জিয়া) কাছে অনেক সুযোগ ছিল। কিন্তু আপনি সংলাপকে না করেছেন, নির্বাচনকে না করেছেন। সর্বশেষ দরজা বন্ধ করেছেন। সব প্রোটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন (আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে)। কিন্তু দরজা বন্ধ রেখে আপনি সেই পথ বন্ধ করেছেন। বন্ধ করুন এ নৃশংসতা, বন্ধ করুন মানুষ মারার রাজনীতি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, পেট্রোল বোমায় পোড়া একজন ট্রাকচালক রাজনীতিবিদদের চেনেন না। বিএনপি যদি পেট্রোল বোমার রাজনীতি না করে, তাহলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিক। মানুষকে পুড়িয়ে মারা রাজনীতি নয়। দেশের রাজনীতি, শিক্ষা, উৎপাদন খাত আজ বার্ন ইউনিটে পুড়ছে। সরকারেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান বলেন, আন্দোলনকারীরা শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। বিএনপি এক মাসের সফল আন্দোলন করে পুরো জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। একমাস ধরে বিএনপি দেখিয়েছে, কীভাবে আন্দোলন করতে হয়।    

আখতারুজ্জামান বলেন, সারাদেশে দিনেরাতে পুলিশি বাণিজ্য চলছে। গ্রামের মানুষ পুলিশের অত্যাচারে ঘুমোতে পারেন না। যে দেশে ৯৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করে, সেখানে পরীক্ষা না নেওয়াই ভালো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, জনগণের সঙ্গে সংলাপ হতে হবে। কিন্তু বিএনপি নেত্রী সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, উদীয়মান জাতির অর্জনকে ধূলিসাৎ করতে কারা এগুলো করছে? তারা সমাজকে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইছে।

তিনি বলেন, রাজনীতি ও গণতন্ত্রের নামে তারা কার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে? এরা কখনোই দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারেনি। বিরোধী দল হিসেবেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। তারা শুধু ক্ষমতায় যেতে চায়। দেশ ও জনগণের জন্য কোনো ধরনের কর্মসূচি দিতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল কি শুধুই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য? তারা জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছে, অথচ তাদের (জনগণ) জন্য কাজ করছে না। যারা মানুষের জন্য রাজনীতি করে না, তাদের বর্জন করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৫

** ‘পেট্রোল বোমাকে কোনো ছাড় নয়’
** দু’পক্ষের জনসমর্থনেই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে
** চিত্ত শুদ্ধ হয়ে আসলেই সংলাপ
** দেশ আজ বার্ন ইউনিটে পুড়ছে
** ‘পরীক্ষা না নেওয়াই ভালো’
** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়
** মানুষের জন্য যারা রাজনীতি করে না তাদের বর্জন করুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।