ঢাকা: দেশে মুসা বিন শমসেরের ব্যক্তিগত কোনো সম্পদই খুঁজে পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফরিদপুরে তার গ্রামে পৈত্রিক ভিটা ছাড়া দেশে আর কোনো বাড়ি-ঘর নেই বহুল আলোচিত এ ব্যবসায়ীর।
ইউটিউবে গুলশান প্যালেস নামে ঢাকার যে প্রাসাদতুল্য বাড়িটি দেখা যায় সেটাও তার নিজের নামে নয়। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এটির মালিক তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা চৌধুরী।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও (বিএফআইইউ) অনুসন্ধান করে দেশে তার কোনো ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব পায়নি।
বিএআইইউএর একজন কর্মকর্তা বুধবার বাংলানিউজকে বলেন, মেসার্স ডেটকো লিমিটেড নামে একটি জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মুসা বিন শমসের। এর অংশীদারিত্বে আরও কয়েকজন রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের নামে ঢাকায় দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে এ ব্যবসায়ীর ব্যক্তি নামে কোনো অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একসময়ে জনশক্তি রপ্তানিতে ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি থাকলেও গত কয়েকবছর ধরে ডেটকো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হয়েছে। (প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান: বাড়ি নম্বর-৫৭, রোড নম্বর-১, ব্লক-১, বনানী, ঢাকা)। তবে এই বাড়িটিও ভাড়া করা বলে অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দুদকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, তিনি বারবার মিডিয়ায় মুখরোচক আলোচনার খোরাক জুগিয়েছেন তার পরিকল্পিত এবং খেয়ালি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
তবে দেশে কিছু না থাকলেও বিদেশে তার প্রচুর সম্পদ থাকতে পারে বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
এর আগে দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বাংলানিউজকে বলেন, তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের কথা আমরা শুনেছি। তিনি কিভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন এবং সুইস ব্যাংকে যে টাকা জব্দ রয়েছে বলে প্রচার হচ্ছে সে টাকার উৎস কি, দেশ থেকে কোনো অর্থ পাচার করেছেন কি-না এগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।
দুদকের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত মুসার বিরুদ্ধে দুদক কোনো অবস্থানে যাওয়ার মতো প্রাপ্ত তথ্য পায়নি। সুইসব্যাংকে তার জব্দকৃত ৫১ হাজার কোটি টাকার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে দুদক আইনি সহায়তার জন্য শিগগিরই সুইজারল্যান্ডে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠাবে।
কয়েকবছর ধরেই বাংলাদেশে রহস্যময় ব্যবসায়ীর নাম মুসা বিন শমসের। প্রিন্স মুসা বলেও তার পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু কেন তিনি প্রিন্স, তার বিপুল সম্পদের উৎসইবা কী- সে তথ্য এখনও রয়ে গেছে অজানা। তবে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তিনি অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত।
তিনি বিশ্ব পরিমণ্ডলেও নানা কারণে আলোচনায় এসেছেন। একবার ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে নির্বাচনে ৫০ লাখ পাউন্ড অনুদানের ঘোষণা দিয়ে, আরেকবার আয়ারল্যান্ডের জাতীয় ঐতিহ্য কালকিনি দুর্গ কিনে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর বানানোর প্রস্তাব দিয়ে।
সর্বশেষ সুইস ব্যাংকে তার সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত হওয়ার খবরের মধ্য দিয়ে মুসা বিন শমসের চমক সৃষ্টি করেছেন সারা দুনিয়ায়। আরও বিস্ময় হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বনন্দিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'লং ওয়াক টু ফ্রিডম' বইটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাংলাদেশের ফরিদপুরের মুসা বিন শমসেরকে! অবশ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ডা. এম এ হাসানের ‘পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী’ গ্রন্থে ১৯৭১ সালে সে সময়ের তরুণ মুসা বিন শমসেরের ভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়।
ওই গ্রন্থের তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসা ছিলেন পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের ঘনিষ্ঠজন আর মুক্তিকামী বাঙালির আতঙ্ক। সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর আরও একবার মুসা বিন শমসের আলোচনায় আসেন দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে। সেখানেও তার রাজকীয় আগমন। চার নারী নিরাপত্তাকর্মীসহ ৪০ জনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর বহর নিয়ে তিনি দুদকের ফটকে গাড়ি থেকে নামেন। সে মুহূর্তে তার ডান হাতে শুভ্র আলোর দ্যুতি, হীরকখচিত বিশ্বখ্যাত রোলেক্স ব্র্যান্ডের অতি দামি ঘড়ি।
মুসা বিন শমসের ১৯৫০ সালের ১৫ অক্টোবর ফরিদপুরের জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাই এবং দুই বোনের মাঝে তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় পুত্র।
তার বাবা শমসের আলী মোল্লা ব্রিটিশ আমলে কৃষি দফতরে চাকরি করতেন।
ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, মুসা বিন শমসেরের মোট অর্থের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সাত বিলিয়ন ডলার আইনি জটিলতায় আটকে আছে সুইস ব্যাংকে।
তবে ফোর্বসের ওই প্রতিবেদন অর্থের বিনিময়ে মুসা বিন শমসের নিজেই করিয়েছেন বলেও মনে করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৫
** ‘রহস্যমানব’ প্রিন্স মুসার সম্পদের খোঁজে দুদক (ভিডিও)