ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

হৃদয় স্যারের চকলেট পাঠশালা

চারপাশের শূন্যতা তাকিয়ে আছে হৃদয়বানদের দিকে

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৫
চারপাশের শূন্যতা তাকিয়ে আছে হৃদয়বানদের দিকে ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: মাথার ওপর খোলা আকাশ, নিচে চট। গাছের ডালে ব্ল্যাকবোর্ড।

কচির কাঁচার মুখে ফুটছে- অ, আ, ক, খ। অ,ই,ঈ,উ। শিশুদের কেউ ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় শিখছে আবৃত্তি, কেউ বা সরস গলাই গাইছে গান। এই হলো চকলেট স্যারের পাঠশালা।

নাম ফুলকুড়ির স্কুল।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতী ইউনিয়নের কান্দিগ্রামে গেলেই দেখা মিলবে এই স্কুলের। তবে এই শিক্ষালয়ে নেই পাঠদানে শিক্ষকের বসার চেয়ার-টেবিল। নেই শিক্ষার্থীদের কোন বেঞ্চ। আছে শুধু হৃদয়। যার টানে আশেপাশের গ্রাম থেকেই ছুটে আসছে কাছে-দূরের শিক্ষার্থীরা।

পাঠের পাশাপাশি কোমলমতি এসব শিক্ষার্থী দীক্ষা নিচ্ছেন সমৃদ্ধ দেশ গড়ায়। দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এভাবেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন হৃদয়।

পুরো নাম মোবারক হোসেন হৃদয়। বাবার নাম মো. ছেনু মিয়া। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে হৃদয় চতুর্থ। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতী ইউনিয়নের কান্দিগ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া হৃদয়কে গ্রামবাসী চেনে ‘আলোকিত হৃদয়’ নামে।   মানে আলোকিত মানুষ হিসেবেই।

জুতার কারখানার সামান্য বেতনের মানুষটিই নিজ গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে গ্রামে গড়ে তুলেছেন প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়। যার নাম ‘ফুলকুঁড়ি স্কুল’। সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার বন্ধ থাকে বিদ্যালয়টি। এছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে পাঠদান। পড়ানো হয় বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ আরবি বিষয়।

বসে প্রাথমিক জ্ঞানের আসরও।

সাধারণ স্কুলের মতোই শিক্ষার্থীদের নাম ডাকা থেকে শুরু করে শিক্ষা অর্জনের মাত্রা যাচাইয়ে কয়েক মাস অন্তর এই পাঠশালায় আয়োজন করা হয় পরীক্ষার।

সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও শিক্ষা লাভের সুযোগ না পাওয়া প্রায় অর্ধশতাধিক শিশুই এখন মাতিয়ে রেখেছে গোটা পাঠশালা।

মোবারক হোসেন হৃদয় প্রায় নয় বছর আগে তাঁর বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেন এই পাঠশালাটি। নির্দিষ্ট কোন ঘর না থাকায় প্রতিবছরই বৃষ্টিতে ব্যাহত হত কচিকাঁচাদের পড়ালেখা। কেননা বৃষ্টি এলেই বই-শ্লেট হাতে শিশুরা দৌড়ে আশ্রয় নিত পাশের কোনো বাড়িতে। কিংবা গাছের নিচে। সেই থেকে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা।

স্বল্প আয়ের সংসার
নিত্য অভাব আর দারিদ্রতার কারণে সময়মতো নিজের শিক্ষা শেষ করতে পারেননি হৃদয়। দারিদ্রের অভিশাপে কৃষক বাবা তাঁকে জুতার কারখানায় কাজ করতে ঢাকায় পাঠান। সেখানে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেন, অগণিত শিশু জীবিকা রক্ষায় কঠোর পরিশ্রম করছে।

লেখাপড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত লাখো শিশুর সম্ভবনা  শেষ  হচ্ছে, সমাজে তৈরি করছে সংকট আর বোঝার। জুতার কারখানার শ্রমিক হিসেবেই এসব বিষয় তখন থেকেই তাঁকে ভাবিয়ে তোলে।
কয়েক মাস ঢাকায় কাজ করে ২০০৬ সালে হৃদয় বাড়ি ফিরে আসেন। এলাকার সমৃদ্ধশালী পরিবারের সন্তানদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন তিনি। মনে মনে অঙ্গীকার করেন নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম গড়ার। নিজেও শুরু করেন ছেদ পড়া শিক্ষা জীবন।

গত বছর এইচএসসি পাশ করার পর এখন পড়ছেন ডিগ্রিতে।

বাড়ি ফিরেই হৃদয়ের শুরু হয় স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথচলা।

তার উদ্যোগেই যাত্রা শুরু করে কচিকাঁচার শিক্ষার আসর ‘ফুলকুঁড়ি স্কুলের’। তখন গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের শিশুই প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যার্জন থেকে বঞ্চিত। প্রায় সবারই পরিবারেই যেন হৃদয়ের জীবনের প্রতিবিম্ব।

লেখাপড়ার সুযোগ বঞ্চিত শিশুরা কেউ শ্রমে কেউবা অপরাধের পথে। কেউ বা আবার বাবার সঙ্গে মাঠেঘাটে কাজে যায়।   আর এলাকার একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও বহু দূরে।   আবার ওই স্কুলে যেতে পার হতে হয় ব্যস্ততম  ভৈরব-কিশোরগঞ্জ  মহাসড়ক। এ বাস্তবতায় শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে এলাকাবাসীকে উদ্ধুব্ধ করতে শুরু করেন শিশুদের শিক্ষালাভে আগ্রহী করতে। চকলেট হাতে শুরু হয় বাড়ি বাড়ি যাত্রা। চলে শিশুদের পাঠশালায় আসতে উৎসাহী করতে নানা তৎপরতা।

হৃদয় বাংলানিউজকে জানান, শুরুর দিকে শিশুরাই নিজ নিজ বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো চটের বস্তা। তা বিছিয়েই চলত শিক্ষা লাভ। এ উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পরে এক বন্ধু বড় একটি চাটাই কিনে দেন। কেনা হয় একটি ছোট ব্লাকবোর্ড। বাড়ির পেছনে গাছতলায় শুরু হয় পাঠশালার আনুষ্ঠানিক যাত্রা।

প্রথম প্রথম নিজেই বই, শ্লেট, চক প্রভৃতি শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ করেন হৃদয়। সাথে রকমারি নানা ধরনের চকলেট। তারপর কেউ চকলেট কেউবা শিক্ষার জন্যে ছুটে আসতে শুরু করেন সেই পাঠশালায়।
 
এভাবেই গ্রামে ক্রমে হৃদয়ের নাম হয়ে যায় চকলেট স্যার।   আর তার পাঠশালার নাম হয় চকলেট পাঠশালা।

ছেলেকে পাঠশালায় পৌঁছে পাশের গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছেলের পড়াশোনা প্রত্যক্ষ করছিলেন শিশু শিক্ষার্থী মাহিদুলের মা হোসনেরা আরা। বাংলানিউজকে তিনি জানান, বাড়ি থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দূরে থাকায় এখানেই দিয়েছেন প্রিয় সন্তানকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পাঠদানের তুলনায় তার ছেলে অনেক কিছু শিখছে। তার মতে, এই বিদ্যালয়টি সকলের হাত ধরে আরো বড় হোক। আমাদের সন্তানরা যেন এখান থেকেই আগামীতেও পড়াশুনা করতে পারে।

করিম উদ্দিন নামের এক গ্রামবাসী জানান, হৃদয়ের উদ্যোগ দেখে আমরা কয়েক বন্ধু মিলেই বছর ছয়েক আগে শিক্ষার্থীদের জন্যে বই-শ্লেটসহ শিক্ষা উপকরণ কিনে দেই।

আমার সামর্থ থাকলে আরো বড় কিছু করে দিতাম।

স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মুজিবুল রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কচিকাঁচাদের শ্রেণীকক্ষে রাখাই কষ্টকর।

তবে হৃদয় তার ‘হৃদয়’ দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে  গাছতলাতে যেভাবে শিক্ষা দিচ্ছে তা সত্যেই অবাক করার মতোই।

দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে নানা সংকট। বিশেষ করে সাধ আর স্বপ্নের কাছে আর্থিক সংকটই যেন বড় বাধা, বলছিলেন হৃদয়।

তিনি জানান,আর্থিক সংকটের কারণেই ফুলকুড়িকে সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না।

ঢাকার একজন শুভার্থীর দেয়া ৮০ হাজার টাকায় ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ১৩ ফুট প্রস্থ একটি ঘর তৈরি করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ঘরের বেড়া জোটেনি। এমনিতেই রিবারের আর্থিক দৈন্যতা। সেই সঙ্গে এই উদ্যোগকে টেনে নিতে বেশ কষ্টই হচ্ছে তার।

কবির সরকার নামের গ্রামের একজন প্রবীণ বাংলানিউজকে জানান, হৃদয় আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমাদের সকলের উচিৎ হৃদয়ের এই উদ্যোগকে এখন এগিয়ে নেওয়া।

টিনের চালের ছাউনি এখন শিক্ষার্থীদের রোদ থেকে রক্ষা করে তবে বৃষ্টির ছাটে ভিজেই যেতে হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।

বৃষ্টির জোড় বাড়লেই পরিমরি করে বাড়ি ছুটতে হয় শিক্ষার্থীদের। মাথায় চাল আর চারপাশের শুন্যতা নিয়ে বিদ্যালয়টি এখন তাকিয়ে আছে অন্য হৃদয়বানদের অপেক্ষায়!

বাংলাদেশ সময়: ০১৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।