ঢাকা: ‘এই হরতাল-অবরোধ আমাগো গলা টিপে ধরছে। আমরা আর বাঁচতে পারতাছি না।
২০ দলীয় জোটের ডাকা চলমান অবরোধ ও হরতালে চরম বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। চলমান এসব কর্মসূচির প্রভাব পড়েছে তাদের বেচাকেনায়।
রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতে বসা স্বল্পপুঁজির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, ৫ জানুয়ারি থেকে চলতে থাকা চলমান এ অবরোধ ও হরতাল প্রতিদিন তাদের অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, শীত মৌসুম উপলক্ষে অনেকেই টাকা ধার করে দোকানে নতুন মাল তুলেছিলেন। কিন্তু হরতাল-অবরোধ তাদের চরম বিপাকে ফেলেছে। একদিকে ঋণের বোঝা, অন্যদিকে আয়ের পথও প্রায় বন্ধ। দুইয়ে মিলে তারা এখন চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর গুলিস্তানের হকার (সার্ট, গেঞ্জি বিক্রেতা) মোহাম্মদ ওমর ফারুক বাংলানিউজ বলেন, প্রতিদিন ৭ /৮ হাজার টাকার মাল অনায়াসে বিক্রি করি। কিন্তু এহন দেড় হাজার টাকার জিনিসও বেচতে পারি না।
বেচাবিক্রি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাগো দোকানগুলো রাস্তায়। আর এই হরতাল-অবরোধে রাস্তাতেই ককটেল বা বোমা পড়ে। তাই, রাস্তার পাশে বসা আমাগো দোকানগুলিরে পাবলিক রিস্ক (ঝুঁকি) ভাবে। তাই, দোকানেও আহে না, বেচাকিনাও হয় না।
ওমর ফারুক আরো জানান, তাদের মূল বেচাবিক্রি হয়, বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। অফিস ফেরত মানুষ বা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ তাদের ক্রেতা। কিন্তু এখন এই হরতাল-অবরোধের কারণে মানুষ সন্ধ্যার পর রাস্তায় থাকে না। এই কারণে বিক্রি কমে গেছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না হলে তাদের অবস্থা এমনই চলবে।
তিনি জানান, শীতের জন্য যে মাল দোকানে তুলেছিলেন, তা বিক্রি করতে পারেননি। গত দুই-তিনদিনের ঠাণ্ডা তাদের আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু হরতাল সব শেষ করে দিলো। রাস্তায় লোকজন আছে ঠিকই; কিন্তু সবাই কাজ শেষে বাড়ি চলে যায়।
হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন তাদের পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি করেন এই হকার।
তিনি বলেন, বেচাবিক্রি নাই মানে হাতে টাকা নাই। এক সপ্তাহের কথা কইয়া একজনের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়া বাচ্চা দুইডারে স্কুলে ভর্তি করছি। এখন যে অবস্থা দেখতাছি, তাতে এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে পারমু না।
হরতাল-অবরোধের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই হরতাল-অবরোধ আমাগো গলাটিপে ধরছে। আমরা আর বাঁচতে পারতাছি না। ঋণের কিস্তির টাকা দিতে পারতাছি না। সামনের দিনগুলোতে ক্যামনে চলমু, বুঝে আইতাছে না।
রাজধানীর পল্টনে ফুটপাতে বসা চশমা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ বিল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, অন্য সময় প্রতিদিন তার দেড় থেকে দুই হাজার টাকার চশমা বিক্রি হয়। কিন্তু গত কয়েকদিনের অবরোধ আর ৭২ ঘণ্টার হরতাল তাদের একেবারে শেষ করে দিয়েছে।
তিনি জানান, ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি টানা দুই দিনের হরতালে ৪/৫টা চশমা বিক্রি করেছেন। আর রোববার ও সোমবার দুই দিনের হরতালে আরো কম বিক্রি হয়েছে। রোববার সারাদিনে মাত্র দুইটা এবং সোমবার দুপুর পর্যন্ত একটা চশমা বিক্রি করেছেন।
বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটের ফুটপাতে বসা হকার মোহাম্মদ আরিফ বাংলানিউজকে বলেন, হরতাল-অবরোধ না থাকলে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার পণ্য (কোর্ট, প্যান্ট, কুটি) বিক্রি হয়। কিন্তু এখন দুই হাজার টাকার মাল বিক্রি করাও কষ্ট হয়ে যায়।
তিনি বলেন, যারা এই ফুটপাতে (পল্টন, বায়তুল মোকাররম) ব্যবসা করেন তাদের অনেকেই এখন হাজার হাজার টাকা ঋণে পড়ে গেছেন। কারণ, সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে দোকানে পণ্য তুলেছেন। প্রতিদিনই কিস্তি দিতে হয়। বিক্রি না হলে কিস্তির টাকা দেবেন কীভাবে!
আরিফ বলেন, এদিকে মাসও শেষ হয়েছে। মাথায় আরেকটা বাড়ি পড়ছে। বাড়ি ভাড়া দিতে হবে। বেচা-বিক্রি নাই। বাড়ি ভাড়া কোথায় থেকে দেবো। এতদিন তো পুঁজি ভেঙে খেয়েছি। বেচাকেনা না থাকলে কিস্তি কীভাবে দেবো! আর বাসা ভাড়া কীভাবে দেবো, সেই চিন্তাতেই ঘুমাতে পারছি না।
গুলিস্তানের ফুটপাতে বসা এক গেঞ্জির দোকানের সামনে কথা হয়, ক্রেতা মোহাম্মদ সেলিম আহমেদের সঙ্গে।
ফুটপাত থেকে সব সময়ই কেনা হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, টুকটাক পোশাক ফুটপাত থেকেই সবসময় কেনা হয়। প্রায় সময়ই অফিস থেকে ফেরার পথে এদিকে একটু উঁকি দিয়ে যাই। তবে এখন একটু কম দেই।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর যে কোনো কর্মসূচিতে মূল ঝামেলা হয় রাস্তায়। আর তাই এই সময় রাস্তায় দাঁড়াই না। গত কয়েকদিন ধরে আমার সন্তান একটা গেঞ্জির জন্য আবদার করছে। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। চোখে পড়লো। তাই, কেনার জন্য দরদাম করছি।
কিন্তু এই হরতাল-অবরোধ আমাদের মতো দিন আনি, দিন খাই মানুষদের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫ ,২০১৫