হরতালের নামে জ্বলছে দেশ, পুড়ছে মানুষ। সংবিধানের দোহাই দিয়ে মৌলিক অধিকারের নামে অগণতান্ত্রিক এ আচরণ বন্ধ চায় ‘গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা পর্ষদ’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন।
এ প্রস্তাব নিয়ে তিন পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ কিস্তি।
ঢাকা: হরতাল বন্ধ নয়, ‘অহিংস হরতাল’ পালনে একটি নীতিমালা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে বেসরকারি সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা পর্ষদ’।
তাদের মতে, হরতাল হচ্ছে জনসাধারণের একটি মৌলিক অধিকার। হরতালের মাধ্যমে কোনো দাবির পক্ষে-বিপক্ষে জনমত প্রকাশ পায়। ৯০ দশকের পর হরতাল হয়ে ওঠে একটি ধংসাত্মক এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারণ। সহিংসতার কারণে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেসব মামলা চলে দিনের পর দিন। কিন্তু কখনো সত্যিকার অর্থে রায় বা শাস্তি হতে দেখা যায়নি।
হরতালের সঠিক প্রয়োগ এবং এর কার্যকারিতার অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এবং হরতালের নামে সহিংসতা ও নাশকতার সুযোগ কমানোর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন প্রণয়ণ দরকার।
এ জন্য দু’টি দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। সেগুলো হচ্ছে-হরতাল আহবান-পালন ও হরতাল আহবানকারী ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সম্পর্কিত নীতিমালা ও নীতিমালা অমান্য করা হলে কি শাস্তি হবে, সে বিষয়ে আইন প্রণয়ন, সহিংসতায় অংশগ্রহণকারীদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির বিধান এবং এ অপরাধের দ্রুত বিচার নিশ্চিতের জন্য বিশেষ আদালত গঠন।
এজন্য হরতাল পালনে একটি নীতিমালা এবং আইনি কাঠামোয় এটাকে কঠোর করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা। এ বিষয়ে একটি আইন করতে পারে। আর সে আইনের প্রস্তাবিত নাম হতে পারে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা আইন-২০১৫’। এতে হরতালের (পক্ষ-বিপক্ষ) উভয়পক্ষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা পাবে।
প্রস্তাবনায় বলা হয়, হরতালের দাবি হতে হবে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও জনগণের কল্যাণে। হরতাল আহবানের আগে হরতালের স্বপক্ষে নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির স্বাক্ষর বা সম্মতি থাকতে হবে। এবং সেটা গণমাধ্যমের সাহায্যে জনগণকে জানাতে হবে। হরতাল ডাকার আগে জনগণকে হরতালের দাবি সম্পর্কে জানানো, জনমত গঠন, হরতালের প্রচার ও জনগণের স্বাভাবিক প্রস্তুতির লক্ষ্যে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা সময় দিতে হবে।
হরতাল আহবানের বিস্তারিত তথ্য ৭৬ ঘণ্টা আগেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে (অনুমতির জন্য নয়)। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা (২/৩ জন) এবং আহবানকারীদের পক্ষ থেকে কয়েকজন ‘পর্যবেক্ষক দল’ হিসেবে হরতালের নীতিমালা মানা হচ্ছে কি-না সেটা পর্যবেক্ষণ করবেন। এবং প্রয়োজনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আইন শৃ্ঙ্খলা বাহিনীকে সুপারিশ করবেন।
হরতাল আহবানের বিষয়ে ব্যাপকভাবে জনগণকে জানাতে হবে। যাতে তারা হরতলের পক্ষে-বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিরোধীরাও এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে পারবেন।
হরতালে সহিংসতা করা যাবে না। যারা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আহবানকারী দল কি ব্যবস্থা নেবে, সেটা হরতাল প্রচারের সময় উল্লেখ করতে হবে। গণমাধ্যমে সেটা প্রচার করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
হরতালে সহিংসতা হলে আহবানকারী দলকেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং এ সম্পর্কে নিরাপত্তা বাহিনীকে এবং গণমাধ্যমকে জানাতে হবে।
৩৬ ঘণ্টা আগে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচার, পিকেটিং বা মিছিল বন্ধ করতে হবে।
এ সময় যারা মিছিল, পিকেটিং বা সহিংসতায় গ্রেফতার হবে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে তাদের মুক্তি দাবি করা যাবে না। যারা এ কাজ করবেন তাদেরকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করতে হবে।
হরতালের দিন যদি কোনো ক্ষয়-ক্ষতির প্রমাণ মেলে তাহলে ক্ষতিগ্রস্তকে আহবানকারী দলকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
গণমাধ্যমকে ডেকে সহিংসতার খবর প্রচার করানো যাবে না। আর গণমাধ্যম এ ধরনের তথ্য পেলে আইন প্রয়োগ সংস্থাকে জানাবে(এ ক্ষেত্রে সোর্স প্রোটেকশন নীতি প্রযোজ্য হবে না)।
হরতালের পরে সফলতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কোনো বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া যাবে না। জনগণই নিজ থেকে তা বুঝে নেবে।
আদালতে বিচারাধীন বিষয় বা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা যাবে না।
মৌলিক অধিকার খর্ব করে এমন দাবিতে হরতাল ডাকা যাবে না।
পাবলিক পরীক্ষা যেমন পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, এ এবং ও লেভেল ইত্যাদির দিনে হরতাল আহবান করা যাবে না।
বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের সফর, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে হরতাল ডাকা যাবে না।
জাতীয় দিবস বা ধর্মীয় দিবসগুলোতে হরতাল করা যাবে না।
সেবা খাত হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।
এরপরও যদি হরতালে অপরাধ হয় তাহলে সে বিষয়ে বিশেষ আইন ও আদালত গঠন সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে সংগঠনটি।
প্রস্তাবনায় বলা হয়, সহিংসতাকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান রেখে বিশেষ আইন প্রণয়ন ও দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করতে হবে।
আদালতে প্রমাণিত হলে নাশকতায় অংশগ্রহণকারীরা ক্ষতিগ্রস্তদেরকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবেন অথবা তার দল থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। অনাদায়ে শাস্তি বৃদ্ধি পাবে।
প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নাশকতার ছবি ও ভিডিও দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করতে সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে।
হরতালের আগে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। শুধুমাত্র হরতাল চলাকালে বা পরে সুনির্দিষ্ট কারণ বা প্রমাণ থাকলে গ্রেফতার করা যাবে। এবং তা বিশেষ আদালতে এই আইনের আওতায় দ্রুত বিচার করতে হবে।
অবরোধ, ঘেরাও ও পিকেটিং মৌলিক অধিকার খর্ব করে। তাই এটাকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করতে হবে।
এসব প্রস্তাবনার আলোকে অন্যান্য মৌলিক অধিকার যেমন সমাবেশ, মিছিল, অবস্থান, ধর্মঘট, অবরোধ, মানববন্ধন, সেবামূলক খাতের ধর্মঘট ইত্যাদি বিষয়েও নীতিমালা ও আইনি কাঠামো করা সম্ভব বলে মনে করে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৫
** হরতাল নিয়ে আইন কি বলে?
** ১০ হাজার কোটি বনাম আড়াই লাখ!
জাতীয়
অহিংস হরতালের জন্য নীতিমালা
ইলিয়াস সরকার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।