ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

দেশে বিয়ের সিজনেও বিয়ে হয় না!

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৫
দেশে বিয়ের সিজনেও বিয়ে হয় না! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: নগরীতে একদা শীত এসেছিল বটে, যখন তোমার আমার ভালোবাসা পরিণতিতে রটে। দুই লাইনের এই কাব্য বোঝায় বিয়ের কথা।



নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। শীতের মৌসুম। এ সময়টা তাই বিয়েরও মৌসুম। আর বিয়ের একটি অন্যতম উপকরণের নাম ফুল। ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত হতে পারে; কিন্তু ফুল থাকুক আর না থাকুক বিয়ে হয়ে যাবে তা তো হতে পারে না। ফুলছাড়া বিয়েই হয় না আমাদের দেশে। এই শীত মৌসুমে বিয়েও যেমন, ফুল বিক্রিও তেমন।

তবে এবার থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে। ফুল বিক্রেতাদের। বাস্তবতা ভিন্ন। টানা হরতাল-অবরোধের কবলে পড়ে এই ভরা মৌসুমেও ফুল বিক্রিতে এসেছে ভাটা, লেগেছে মন্দা। আর তাই তো শীতের হিমেল হাওয়া ভরা বিকেলে বিষন্ন দৃষ্টি শাহবাগের ফুল বিক্রেতা মো. জসিমের (৩৪)। এমনি আট-দশটা দিনে তার ফুল বিক্রি দৈনিক ৫ হাজার টাকার মতো। আর শীত মৌসুমে, বিয়ের সময় হলে তো সে বিক্রি ৭/৮ এ গিয়ে ঠেকতো।

তবে এ বছর বিয়ের মৌসুমেই তার বিক্রি নেমে এসেছে মাত্র হাজার দুয়েক টাকায়! তাই দুঃখভরা মন নিয়ে জসিম বাংলানিউজকে বলেন, হরতাল-অবরোধে ব্যবসাটা খাইলো। আগে বিয়ের সিজন ছাড়াই বেচাবিক্রি ছিল ৫ হাজারের মতো। আর এহন সাধারণ দিনের চেয়েও অর্ধেক ব্যবসা হচ্ছে। এই ক্ষতি কেমনে পুষামু! অহন তো দেখি দেশে বিয়ের সিজনেও বিয়ে হয় না!
 
এর একটা ব্যখ্যা দাঁড় করিয়ে জসিম বাংলানিউজকে আরও বলেন, হরতাল-অবরোধে মানুষ বিয়ে করাও কমাইয়া দিসে। আর যারা করতাসে তারাও ফুলের বাজেট কমায়া ফেলসে। আগে এমনও দেখসি- সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরাও বিয়েতে হাজার দশেক টাকার ফুল কিনসে। আর বড়লোক হইলে তো কথাই নাই। কিন্তু এহন ওই মধ্যবিত্তরাই ফুল কিনতাসে দেড়-দুই হাজারের। আমরা এহন পরিস্থিতি এমন দেখতাসি যেন দেশে বিয়ের সিজনেও বিয়ে নাই!
 
জসিমের দুই ছেলে। বড়জন ক্লাস সেভেনে পড়ে, আর ছোট ছেলের বসয় সবে ৩। স্ত্রী সংসার নিয়ে থাকেন খিলক্ষেতে। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে তিনি শাহবাগে ব্যবসা করছেন। ভরা মৌসুমে এমন মন্দা ও ক্ষতির মুখোমুখি শেষ কবে পড়েছেন তা মনে করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, এমন ক্ষতি আগে কখনই পড়ি নাই। এহন তো ঢাকার বাইরে থেকে যে ফুল আইবো তারও উপায় কম। ট্রাক চালকরা তো ভয়েই ট্রাক নিয়ে আসা কমাইয়া দিসেন। এতে ক্ষতি শুধু আমগোরই না, সারা বাংলাদেশের ফুল চাষীদেরই ক্ষতির মইধ্যে পড়সে।
 
আসে না ক্রেতা। মাথায় হাত দিয়ে সময় পার করা রোজকার নিয়তি এখন তাদের। চারিপাশে থোকা থোকা ফুলের সুগন্ধ, তবে সে সুগন্ধ তাদের ছুঁয়ে যায় না। এতো ফুল, কিন্তু নেই ক্রেতা! এতে লাগেনা আগের মতো আনন্দ। ভরা মৌসুমে এ মন্দা মেনে নেওয়াই দায়।

সারাদেশের খুচরা বিক্রেতারা রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট ও আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ফুলের পাইকারি মার্কেট থেকে ফুল কিনে থাকেন। বিশেষ করে শাহবাগের পাইকারি বাজারের ফুল রাজধানীসহ সারাদেশে যায়। অর্থাৎ এই শাহবাগই ফুলের সব বড় পাইকারি মার্কেট। আর ভরা মৌসুমে এই বড় মার্কেটে এসে বিক্রেতাদের বিষন্নতা জসিমের মতো পলাশ শেখেরও (৩৫)। তার দোকানটা খানিক বড়। তার আগে দৈনিক বিকিকিনি হতো প্রায় ১০ হাজার টাকার। এখন যা নেমে এসেছে ৩ থেকে ৫ হাজারে। তিনি বলেন, সব ব্যবসারই একটা ভরা মৌসুম থাহে। আমাগো লাইগা যা শীতে। তবে এইবার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাগো পুরো বছরের প্রত্যাশাডাই শেষ কইরা দিল।
 
পলাশ শেখ আরও বলেন, দেশে মানুষরে জ্বালাইয়া মারা হচ্ছে। মানুষ নিরাপত্তা পাইতাসে না। স্কুল-কলেজ হয় না। সব ব্যবসায় কম-বেশি মন্দা। এভাবে কতদিন যাইবো এটা হাসিনা-খালেদা আপার কাছে জানবার চাই। দেশের মানুষ যে উৎসব উদযাপন কইরবো তাও আপনাগো লাইগা পারতাসে না।
 
মৌখিক এক হিসাব কষে তিনি বলেন, শাহবাগে মোট ৫৬টি ছোট-বড় ফুলের দোকান রইসে। প্রতি দোকানে যদি গড়ে ডেইলি ৫ হাজার করেও বিক্রি হয় তয়, টাকার অংকে ডেইলি বিক্রি ২ লাখ ৮০ হাজার। মাস শেষে যা অয় ৮ কোটি ৪০ লাখে। গত এক মাসের এই অবরোধ ও হরতালে আমাগো এই সেক্টরে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হইয়া গেলো। এই হিসাব তো সাধারণ দিনের। যদি বিয়ের মৌসুম হিসাব কইরা অংক কষতাম তয় তা দাঁড়াতো আরও অনেক বেশিতে। আমাগো মতো এমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর এই ক্ষতি অনেক বড় ক্ষতি।
 
চলমান সহিংসতায় ফুল বিক্রেতা জসিম, পলাশদের মতো মাথায় হাত বিল্লাল হোসেন সবুজ (৩০), এনামুল হক কলিদের (২৪) মতো প্রতিটি দোকানির। তারা বলছেন- এই ক্ষতি শুধু তাদের একার না। দূর গাঁয়ের ফুল চাষী থেকে শুরু করে ফুলের সরাসরি পাইকারি ক্রেতা, পরিবহন সংশ্লিষ্টরা, খুচরা ব্যবসায়ীদের ক্ষতিও কম হচ্ছে না।
 
শাহবাগে ফুলের বিশাল পাইকারি বাজারে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিদিন দেশের প্রায় ১৯/২০টি জেলা থেকে ফুল আসে। রজনীগন্ধা, লাল ও সাদা গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, কেলোনজরা, চন্দ্রমল্লিকা, ভুট্টা ফুল, বেলি, কামিনী, সূর্যমুখী, ডায়মন্ড, গরম ফেনিয়া, রতপুসুটি, টুনটুনি, জিপসি, স্টারকলি, ডালিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল পাওয়া যায় এখানে।
 
ফুল বেশি আসে- সাভার, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেট, যশোর, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা জেলার। মূলত বাসের ছাদ, পিকআপ ও ট্রাকে আসে ফুল। আসতে দেরি হলে ফুল বেশি নষ্ট হয়। তবে শীত মৌসুমে নষ্ট হয় না তেমন। ফলে এ মৌসুমে ‘বিয়ের সিজন’ হিসেবেও ফুলের চাহিদা প্রচুর। অন্যদিকে, ফুল ব্যবসার জন্য শীতই উপযুক্ত ঋতু। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক সহিংসতায় যার পুরোটাই ভেস্তে গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০২২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।