ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বেডে যন্ত্রণায় দগ্ধরা, শীতে কাবু স্বজনেরা

রহমত উল্যাহ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৫
বেডে যন্ত্রণায় দগ্ধরা, শীতে কাবু স্বজনেরা ছবি: নাজমুল হাসান / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: শরীরে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণায় হাসপাতাল বেডে কাতরাচ্ছেন হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোল সন্ত্রাসের শিকার নারী-পুরুষ। পোড়া রোগীদের কাছে রাত দিন যেন একই সমান।

গভীর রাতেও পোড়ার যন্ত্রণায় জেগে আছে অনেকে। আর পোড়া রোগীদের সেবা করতে আসা স্বজনরাও যে শীত যন্ত্রণায়। রোগীদের সেবা করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানা না থাকায় তীব্র শীত উপেক্ষা করে শুয়ে পড়ছেন মেঝেতেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ(ঢামেক) হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে পোড়া রোগী ও তাদের স্বজনদের রাতের চিত্র এমনই। রোগীর স্বজনদের দাবি, ঘুম, শীত উপেক্ষা করে বাঁচা যায়। কিন্তু পোড়ার কষ্ট নিয়ে বাঁচা যায়না। যন্ত্রণায় অনেক রোগী বলে, এভাবে বাঁচার চেয়ে একটু বিষ দাঁও খেয়ে মরে যাই।

গত ২০ জানুয়ারি সাভারে তিতাস পরিবহনের বাসে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন আবদুর রশিদ। পুড়ে যায় শরীরে ৮০ শতাংশ। ঐদিন রাতেই ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে।

শরীরের কোন অংশ বাকি না থাকায় পোড়া যন্ত্রণায় আইসিইউ’তে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন রশিদ। এমন পোড়া রোগীকে সেবা করতে ছুটে আসেন স্ত্রী রাশেদা বেগম ও ছেলে মো. হাফিজুল।

দিন রাত পালাক্রমে রশিদের কাছে আছেন রাশেদা ও হাফিজুল। রাত হলে বিছানা আর ঘুমানোর জায়গা না থাকায় রাশেদা বেগম আইসিইউ সামনের মেঝে (ফ্লোর) ও ছেলে হাফিজুল নিচতলায় জরুরি বিভাগের সামনের মেঝেতে ঘুমান।

তীব্র শীতের সাথে মশার আর চোরের যন্ত্রণা তো রয়েছেন। কিছুক্ষণ পরপরই আবদুর রশিদকে দেখতে যেতে হয়। শীত উপেক্ষা আর ঘুম নষ্ট হলেও স্বামী বেঁচে আছে এই ভেবে রাশেদা বেগম আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।

রাশেদা বাংলানিউজকে জানান,‘ স্বামীর পোড়ার যন্ত্রণার কাছে ঘুম, শীত আর মশার যন্ত্রণা কিছু না। পোড়া মানুষটা কি কষ্ট পাচ্ছে তা কেউই জানে না। বারবার বলে, মরে যাওয়ার কিছু থাকলে দাও খেয়ে মরে যাই। ’

তিনি বলেন,‘ আইসিইউ’র সামনে কিছুক্ষণ ঘুমাই। ঘুম তো আসে না। যারা পেট্রোল বোমায় মেরেছে আল্লাহ তাদের বিচার করবে। আর কোন মানুষ যাতে পেট্রোল সন্ত্রাসের শিকার না হন সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই। ’

হাফিজুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘ আজ ১৬ দিন একইভাবে ঘুমাই। বাবার পোড়ার কথা মনে হলে ঘুম আসে না। তবু কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। তার মতো শত শত মানুষ এভাবে শুয়ে থাকে। কত দিন এমন থাকতে হবে জানিনা। ’



হাফিজ বলেন, বাবার কোন অসুখ হলে মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু জীবন্ত একটা মানুষকে পুড়িয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ফায়দা লুটছে দেখে অবাক লাগে। এ কোন দেশে বাস করি যেখানে মানুষ পুড়িয়ে নেতারা সুখ পায়। হাফিজুলের মতো শত শত রোগীর স্বজন রাত পার করতে অসহ্য কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করে মেঝেতে ঘুমিয়ে থাকে।
 
শুক্রবার ছুটির দিনে শ্বশুরকে দেখতে বার্ন ইউনিটে আসেন আবদুর রশিদের মেয়ে জামাই শাহেন শামীম। তিনি বাংলানিউজকে জানান, পোড়া রোগী দেখলে আর ঘুম আসে না। তবুও যারা সারাদিন থাকেন, রাতে যেখানে জায়গা পান সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন।
 
২৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়িতে পেট্রোল মারাত্বক দগ্ধ মো. সালাউদ্দিন। শীতে পোড়ার যন্ত্রণা যেন সহ্য করতে পারছেন না। স্ত্রী হাজেরা আর ছোট ভাই সাহিদুল সেবায় একাট্টা।
 
কিন্তু রাত নামলে বিপত্তি। রাত হলেই যেন যন্ত্রণা বেডে যায়। স্ত্রী হাজেরা বাংলানিউজকে জানান, রাত হলেই যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারে না। পোড়ার যন্ত্রণা কত ভয়ঙ্কর তা পেট্রোল সন্ত্রাসীরা তো বুঝবে না।
 
তিনি বলেন, রাতে ঘুমাতে হয় মেঝেতে। শীতের সাথে মশার যন্ত্রণা তো রয়েছে। এত যন্ত্রণা না দিয়ে বিধাতা যেন প্রাণটা নিয়ে যায়। তিনি সহিংসতার নামে  যারা এসব করছে তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন।

সাহিদুল বাংলানিউজকে জানান, দিন শেষ হওয়ার আগেই পোড়া রোগীর স্বজনদের মাঝে হতাশা কাজ করে কিভাবে রেস্ট নেবে। পোড়া রোগীর যন্ত্রণায় সবাই তো কাতর। তাই ঘুমাতে গেলে সবাই যেন স্বজন হয়ে যায়।
 

রাত হলেই ঢাকা মেডিকেল বার্ন ইউনিটের নিচতলা, আইসিইউ সামনে, সব ওয়ার্ডের সব মেঝে যেন পোড়া রোগীদের বিছানা হয়ে যায়। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শীত আর মশার যন্ত্রণা সহ্য করে ঘুমিয়ে পড়ে স্বজনরা।
 
বেডে পোড়ার যন্ত্রণায় কাতর থাকে পেট্রোল সন্ত্রাসের শিকার রোগীরা। আর পোড়াদের স্বজনরা তীব্র শীত, মশার যন্ত্রণা উপেক্ষা করে রাত পার করে। রাত হলেই বার্ন ইউনিটে পোড়া রোগী আর স্বজনদের এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।