ঢাকা: কতই বা বয়স! বড়জোর দুই কি আড়াই বছর! মায়ের কোলেই উসখুস করছিল মিথিলা। সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি।
কোলেই বা কতক্ষণ থাকা যায়! কোল ছেড়ে নেমে যেতে চাইলেই নিজের অজান্তেই আবার টেনে কোলেই টেনে নিচ্ছেন মা।
কখনোও খামচি কেটে মাকে বিরক্তি করা, কখনোও অচেনা লোকগুলোর দিকে অপলক চেয়ে থাকা। কিন্তু ছোট্ট এই মিথিলার সামনে অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত ভবিষ্যত।
কোনো দোষ না করেই নিষ্পাপ শিশুটিকে মায়ের সঙ্গেই যেতে হচ্ছে হাজতে! এ সিদ্ধান্তেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে মা মাসুদার। কোলে মিথিলা। আর ঘরে যমজ কন্যা কুসুম (১০), কলি (১০) আর ছেলে মাসুদ (৭)।
ওদের কে সামলাবে? সন্ধ্যায় মায়ের কোল জুড়ে কে ঘুমুবে? কে আদর করে বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেবে?
এমন সব দুশ্চিন্তায় দিনের আলোয় অন্ধকার মনে হয় মাসুদার চোখে। হতাশা আর নির্লিপ্ততা অদ্ভূত এক দৃষ্টি তখন মাসুদার চোখেমুখে।
সাভারের মাদক পল্লী হিসেবে পরিচিত আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে গাঁজা বিক্রি করতেন মাসুদা। সবে দু’দিন হয় এসেছিলেন এই পেশায়!
স্বামী পরিত্যাক্তা হিসেবে ভাগ্যই তাকে টেনে এনেছিল এ পথে!
প্রতিদিন হাজার টাকার গাঁজা কিনে তা ৫০ ও ১শ’ টাকার পুরিয়া করে বিক্রি করতেন।
দিন শেষে চার থেকে ৫শ’ টাকা আয় হত তার। এভাবেই দু’দিনের স্বপ্ন দু:স্বপ্নে পরিণত হয়!
তৃতীয় দিনের আয় দিয়ে সন্তানের স্কুলের জামা আর বই কিনে দেবার পরিকল্পনা নিয়েই সোমবার সকালে আড়াই বছরের শিশু কন্যাকে কোলে নিয়েই এই পথে নেমেছিলেন মাসুদা।
বিধি বাম! র্যাবের অভিযানে ধরা পড়েন তিনি। নেওয়া হয় মিরপুরে র্যাব-৪’র কার্যালয়ে।
র্যাবের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) কবির উদ্দিন সরকার এজাহার নিয়ে সোমবার বিকেলে হাজির হন সাভার মডেল থানায়।
সেখানেই বিপত্তি বাধে। মাসুদা না হয় আসামি কিন্তু শিশুটি তো কোনো অপরাধ করেনি।
তাহলে তাকে কেন হাজতে যেতে হবে- থানার বড় বাবুর এ প্রশ্নে থমকে যায় র্যাবের মামলা।
মাসুদাকে বলা হয়, শিশুটিকে পরিচিতজনদের কাউকে দিয়ে বাড়ি পাঠাতে।
‘স্বামী তো আগেই ছাইড়া গেছে, স্যার আমার তো বাড়িতে ওরে দেহনের কেউ নাই,আর মা ছাড়া এই মাইয়াডা কিছুই বুঝে না’- মাসুদার এ কথাতে বিপাকে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তারা।
শিশুটির বর্ণনা এজাহারে না থাকায় তাহলে শিশুটির দায়িত্ব নেবে কে- এ প্রশ্নে সাভার মডেল থানার ওসি মোতালেব মিয়া র্যাব কর্মকর্তাদের বলেন, আমি শিশুটিকে কি করে হাজতে পাঠাব!
তার কথা তো এজাহারের কোথাও লেখা নেই! এভাবে মামলা নিতে পারব না।
আর নিলেও আদালতের আদেশ না থাকলে কারাগারও শিশুটির দায়িত্ব নেবে না।
তার চেয়ে এজাহার সংশোধন করে আসুন, মায়ের সঙ্গে দুধের শিশুটিও ছিল এই বর্ণনা দিন এজাহার নিচ্ছি, তার আগে নয়, ওসির এ বক্তব্যে এবার বিপাকে পড়ে র্যাব।
সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, এজাহার সংশোধন করা হবে, আসামি হিসেবে মায়ের সঙ্গে থাকবে শিশুটিও।
নতুন করে এজাহার করতে ফিরে যান র্যাব কর্মকর্তারা।
একদিকে মামলা দায়েরের অপেক্ষায় ডিউটি অফিসার আর অন্যদিকে মাসহ নিষ্পাপ শিশুটির অপেক্ষায় হাজতখানা।
সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোতালেব মিয়া বাংলানিউজকে জানান, শিশুর বিষয়টি এমনিতেই স্পর্শকাতর।
নিষ্পাপ শিশুটিতে হাজতখানার মতো পরিবেশে থাকা যেমন অমানবিক আবার মা ছাড়া শিশুটির থাকাটাও অনিরাপদ।
আমাদের কিছুই করার নেই। এখন মায়ের অপরাধেই শিশুটিকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
সাভার মডেল থানার ডিউটি অফিসার দুলুমা বড়ুয়া বাংলানিউজকে জানান, শিশুটির অধিকারের বিষয়ে আমরা সচেতন তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের হাত বাঁধা।
আইনের হাত অনেক কঠিন!
আসলেও কঠিন। অন্তত নিষ্পাপ মিথিলাদের জন্যে- এমন মন্তব্যই প্রতিধ্বনি হলো থানার এ দেয়াল থেকে ও দেয়ালে!
বাংলাদেশ সময়: ২১৪২ ফেব্রয়ারি ১৬, ২০১৪