পার্বতীপুর(দিনাজপুর): ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা শুরু থেকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।
তবে, পার্বতীপুরে ভাষা সৈনিকদের তথ্য সংরক্ষিত না থাকায় বিরাট একটি অংশ ইতিহাসের অতলে হারিয়ে গেছে।
২০০৬ সালে ২১ শে চেতনা পরিষদ, পার্বতীপুর শাখার উদ্যোগে ভাষা সৈনিকদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করা হয়। ২০১৪ সালে ২১ শে চেতনা পরিষদ ৩৯ জন ভাষা সৈনিকের একটি তালিকা প্রকাশ করে। কেউ কেউ এই তালিকা পক্ষপাতদুষ্ট বললেও দীর্ঘদিন পর ভাষা সৈনিকদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করায় সাধুবাদ জানিয়েছে বেশিরভাগ মানুষ।
ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। যে কয়েকজন জীবিত আছেন তাদের কেউ কেউ দেশের বাইরে, কেউ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছেন।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় পার্বতীপুরে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
পার্বতীপুর জ্ঞানাঙ্কুর এইচ ই স্কুল (বর্তমান জ্ঞানাঙ্কুর পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়), রেল প্রাইমারি ইউপি স্কুল ও গালর্স এম ই স্কুলের (বর্তমান গার্লস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রী শহরে প্রতিবাদ মিছিল করে এবং জ্ঞানাঙ্কুর স্কুল মাঠে সমাবেশ করে। জ্ঞানাঙ্কুর হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র এম শাহীদ তাতে সভাপতিত্ব করেন। এই খবর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য আন্দোলনরতদের ও ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পার্বতীপুরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীসহ প্রায় ৫ হাজার সংগ্রামী জনতা শহরের বিক্ষোভ মিছিল করে এবং বিকেলে জ্ঞানাঙ্কুর হাইস্কুল মাঠে সমাবেশ করে। যা ২৭ ফেব্রুয়ারি আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
তাছাড়া পার্বতীপুরের ভাষা সৈনিক প্রয়াত গোলাম কিবরিয়া ও আব্দুল হামিদ হিলিরেল স্টেশনের দুইশ গজ পশ্চিমে ভারতের হিলি বাজারের যমুনেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত যমুনা প্রেস থেকে হ্যান্ডবিল ছেপে এনে জনতার মাঝে বিলি করেছিলেন।
সে সময় পার্বতীপুরে ভাষা আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে জীবিত রয়েছেন- পলাশবাড়ী ইউনিয়নের খোলাহাটি ডাঙ্গারহাটের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আলহাজ মোসলেহ উদ্দিন, শহরের পুরাতন বাজারের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পার্বতীপুর ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আলহাজ শামস্ উদ্দিন আহমেদ, রামপুর ইউনিয়নের সরকার পাড়ার আলহাজ আব্দুল মান্নান, হরিরামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আফসার আলী, শেরপুর গ্রামের প্রবীণ আইনজীবী সরদার মোশারফ হোসেন সাবেক এমসিএ ও এমপি (দিনাজপুর শহরে বসবাসরত), পার্বতীপুর শহরের মোজাফ্ফর নগরের মরহুম রাহাতুল্লাহর (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) ছেলে ও আব্দুল খালেকের ছোট ভাই আব্দুল জলিল (বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত), যোগেষ ভট্টাচার্য (ভারত প্রবাসী) এবং ডক্টর আব্দুল বারির (ইংল্যান্ড প্রবাসী) নাম জানা যায়।
এছাড়া যারা বেঁচে নেই তাদের মধ্যে ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র পার্বতীপুর ভবানীপুরের আব্দুল হাকিম সরদার, শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ডা. ক্যাপ্টেন আবুল হোসেনের ছেলে ডা. শামসাদ আলী, শহরের মোজাফ্ফর নগরের মরহুম রাহাতুল্লাহর ছেলে আব্দুল খালেক, পুরাতন বাজারের আব্দুস সাফী, হলদীবাড়ীর আফতাব উদ্দিন (ট্রেন পরিচালক), নয়াপাড়ার জহুরুল হক, পার্বতীপুরের বিশিষ্ট শিল্পপতি ব্যবসায়ী এ.জেড.এম রেজওয়ানুল হকের (সাবেক এমপি) বাবা আব্দুল জব্বার, হাবড়া ইউনিয়নের ভবানীপুর পূর্ব শেরপুরের গোলাম কিবরিয়া, ইসলামপুরের মকবুল হোসেন সরদার, আব্দুল হামিদ, আব্দুল মান্নাফ, বজলু, জাফর, চন্ডিপুরের নিজাম উদ্দিন, দারাজ উদ্দিন, পুরাতন বাজারের আনসার আলী, পলাশবাড়ী ইউনিয়নের কালিকাপুরের আব্দুর রাজ্জাক, হুগলীপাড়ার ডাক্তার আব্দুর রহমান, গুলশান নগরের ডাক্তার আব্দুল খালেক, পার্বতীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান এমএ আউয়াল প্রমুখ।
এদের মধ্যে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবাঙালিরা আব্দুল হাকিম ও ডাক্তার শামসাদকে নৃশংসভাবে কয়লার ইঞ্জিনে পুড়িয়ে এবং মকবুল ও জাফরকে হত্যা করে।
সে সময় আব্দুল খালেকদের বাসা ছিল পার্বতীপুরে ভাষা আন্দোলনের নেতাদের আশ্রয়স্থল। আর জ্ঞানাঙ্কুর এইচ,ই স্কুল মাঠে ভাষা আন্দোলনের সভা সমাবেশ হতো। যার ফলে জ্ঞানাঙ্কুর হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫২ সালে জ্ঞানাঙ্কুর হাই স্কুলের মেট্রিক পরীক্ষার্থী রামপুর ইউনিয়নের সরকার পাড়ার আলহাজ্ব আব্দুল মান্নান(৮৫) ও দশম শ্রেণির ছাত্র বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পার্বতীপুর ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আলহাজ শামস্ উদ্দিন আহমেদ(৮০)বাংলানিউজকে জানান-সহপাঠীদের নিয়ে তাঁরা নিয়মিত মিছিল মিটিং এ যেতেন। আর এতে নেতৃত্ব দিতেন আব্দুল খালেক(ফটো খালেক)।
অধ্যক্ষ আলহাজ শামস্ উদ্দিন আহমেদ অক্ষেপ করে বলেন- ভাষা পেয়েছি, দেশ পেয়েছি কিন্তু তাদের খোঁজ কেউ রাখেনি। এত বছর পর ২০১৪ সালে ‘২১শে চেতনা পরিষদ’ পার্বতীপুর শাখার সভাপতি মোজ্জামেল হক তাদের সম্মাননা দিয়েছেন।
‘২১শে চেতনা পরিষদ’ পার্বতীপুর শাখার সভাপতি মোজ্জামেল হক বাংলানিউজকে জানান- দীর্ঘ ৬৫ বছর পর ভাষা সৈনিকদের নির্ভুল তালিকা করা অনেক কঠিন কাজ। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে প্রকৃত ভাষা সৈনিকদের খুঁজে বের করার। প্রয়োজনে তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন করা হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেছেন। যাদের কল্যাণে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার ভাষা আন্দোলন আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত এবং জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত।
বাংলাদশে সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫