খুলনা থেকে ফিরে: থাকার মতো ঘর বলতে ছিলো মাত্র একখানা চারচালা টিনের ঘর। সেখানেই ছেলে, মেয়ে ও স্বামী নিয়ে থাকতেন শিখা রানী সরকার (৫২)।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত টানা দেড় ঘণ্টার শিলাবৃষ্টিই সব কেরে নিয়েছে তার।
শিখা রানী সরকার বাস করেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার তিন নম্বর রুদাঘরা ইউনিয়নের শোলঘাতিয়া গ্রামে। জেলেপাড়া বলে খ্যাত এ গ্রামে তারমতো ৮০টি পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। অথচ দুদিন আগেও হাসি-খুশিতে ভরা ছিলো জেলে পরিবারগুলো।
শিখা রানী তার কষ্টের কথা বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন এভাবে, ‘আমি এখন কই থাকবে রে। আমার কী হইবো রে। আমি কোথায় যাবো। আমার যে কিছুই রইলো না। বৃষ্টি আমার ঘরের টিন না আমাদের বুক ফুটো করে দিয়েছে। ’
তিনি বলেন, মানুষের বাড়িতে কাজ করে বহু কষ্টে এ ঘরটা দিয়েছিলাম। ঘর দিতে গিয়ে মানুষের কাছে দেনা হয়েছি। এই দেনা দিবো কী দিয়ে আর খাবো কি?। ও ভগবান আমার নিয়া গেলা না কেন। এসব বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শিখা রানী। তার সঙ্গে যোগ দেন তারপুত্র বধু দ্বীপিকা রানী সরকার (৩০)।
পুত্রবধু দ্বীপিকা রানী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ঘরের টিনের কোনো অংশ বাকি নেই। সবই ফুটো হয়ে গেছে। ঘরের চালা দিয়ে সহজেই সূর্য্যের আলো ঢুকে যাচ্ছে। চালার নিচ থেকেই আকাশ দেখা যায়। আমরা কিসের নিচে থাকবো। কে দেবে আমাদের ঘর। কেউ দেখতে আসেনি। আমারে কে দেখবে।
শুধু শিখা রানী বা দ্বীপিকা রানী নয় এই গ্রামের ৮০টি পরিবারের অবস্থা এখানো আসমানীদের মতো। একটু খানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
শুধু জেলেপাড়া নয় পাশের ঋষিপাড়া গ্রামের ২৪০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া স্থানীয় হিন্দু ধর্মালম্বীদের মন্দীরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া রুদাঘরা জেলাপাড়ার ৫০/৬০ ঘরের অবস্থাও শোচনীয়।
শিলাবৃষ্টির পরদিন ক্ষতিগ্রস্ত জেলেপাড়ার লোকদের দেখতে আসেন উপজেলা চেয়ারম্যান খান আলী মুনসুর। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শুধু আশারবাণী শুনিয়ে আসেন তিনি। আজ অবদি মেলেনি কোনো সহায়তা। আসেনি সরকারি কোনো অর্থ সাহায্যে বা ত্রাণ। এমনকি একবারের জন্যেও আসেনি স্থানীয় এমপি নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। যিনি আবার সরকারের মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। নিজ ঘরের ছেলে হিসেবেই দেখতেন জেলে ও ঋষিপাড়ার অসহয় মানুষগুলো।
তাইতো প্রতিমন্ত্রীর ওপর নিজেদের ক্ষোভ ঝাড়তেও দ্বিধা করেননি তারা। এখন আসবে কেন, ভোট আসলেই দেখা যাবে। তখন সবাই কাকীমা হয়ে যাবে। ৩ নং রুদাঘরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম আমান উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, আমি জেলাপ্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা আমার কাছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা চেয়েছে। আমি ইতোমধ্যে তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি। তবে কতটুক সহযোগিতা করতে পারবো বলা মুশকিল। কেনন না সরকারি সাহায্য কবে আসবে কবে দিবো, সে নিয়ে ভাববার রয়েছে। এজন্য তিনি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা আহ্বান করেন।
তিনি বলেন, যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে এখন কে দিলো না দিলো সেটা বিষয় না। এলাকাবাসীসহ সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
এ নিয়ে কথা হয় স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিএম মুঞ্জুরুল হকের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সকালে আমরা স্কুলে আসার পথে দেখতে পাই গ্রামবাসীর কান্নার রোল। এদিন স্কুলে ছেলে মেয়েরাও আসেনি। অনেক ছেলে মেয়ের বই খাতা বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর আমি স্কুলের সহকারী শিক্ষক রমেশ কুমার সরকারকে নিয়ে জেলেপাড়ায় যাই। জেলেনীদের শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের কাছে স্বান্তনা এখন বিষাদ।
এদিকে শিলাবৃষ্টির পর থেকেই বাংলানিউজের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে কয়েকদফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সঙ্গে। কয়েকদফা চেষ্টার পর একবার মিললেও ব্যস্ত আছি বলেই তিনি কেটে দেন লাইন। এরপর আর তাকে পাওয়া যায়নি।
দেড় ঘণ্টার শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। দুই দিন বন্ধ থাকার পর ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
তবে এখনো যায়নি ক্ষতির রেশ। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন জেলেপাড়া ও ঋষিপাড়ার ভাগ্য বিড়ম্বনারা। শুধুমাত্র থাকার ঘর যে গেছে তা নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেতের ফসলও।
ওই এলাকার ধানক্ষেত, গমক্ষেত, কলাবাগানসহ সব ফসলের উপর দিয়ে গেছে এ তাণ্ডব। কোনো কিছুই বাদ যায়নি প্রকৃতির এ নিষ্ঠুরতা থেকে। সহসাই কাটিয়ে উঠতে পারবে কি এ ক্ষতি? এমন প্রশ্ন এলাকাবাসীর। তবে এর জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা।
বিগত ৭৮ বছরেও এমন অভিজ্ঞতা নেই বলে বাংলানিউজের কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দা গাজী রউফ। তিনি বলেন, আমার জীবনে এমন শিলাবৃষ্টি দেখিনি। বৃষ্টি শেষ হওয়ার পরে ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালেও শিলাপাথর পাওয়া যায়। তবে এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫