ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের মামলার রায় দেওয়া হবে মঙ্গলবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার শান্তি (পিস) কমিটির চেয়ারম্যান জব্বারের মামলার রায় ঘোষণা করবেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার অভিযুক্ত হয়েছেন ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে। এগুলোতে ৩৬ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ২শ’ জনকে ধর্মান্তরিতকরণ এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে ৫শ’ ৮৭টি বাড়ি-ঘর ধ্বংস করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
১৯৮৮ ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার জব্বার। ৮০ বছর বয়সী জব্বার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ছেলে-মেয়ের কাছে পালিয়ে আছেন বলে ধারণা করছেন প্রসিকিউশন।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রেম
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৯ মে তদন্ত শুরু করে গত বছরের ২৮ এপ্রিল শেষ করা হয়। পরদিন ২৯ এপ্রিল তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করেন তদন্ত সংস্থা। ৫টি অভিযোগে ৭৯ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে মোট এক হাজার ৯শ’ পৃষ্ঠার এ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়।
ওই প্রতিবেদনের নথিপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণসহ যাবতীয় বিচার বিশ্লেষণ করে ৫টি অভিযোগে ৭৯ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়। গত বছরের ১১ মে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ জাহিদ ইমাম এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
গত বছরের ১২ মে ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনীত ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। তবে তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করতে না পারায় নিয়ম অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। তাতেও তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় গত বছরের ৮ জুলাই তার অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ চলার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে পলাতক অবস্থায় বিচার শুরু করার জন্য আসামি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের পক্ষে মোহাম্মদ আবুল হাসানকে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ১৪ আগস্ট আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে গত বছরের ২০ জুলাই জব্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা। অপরদিকে অভিযোগ গঠনের বিরোধিতা করে শুনানি করেন তার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান।
৭ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম।
গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ জন সাক্ষী। তাদের মধ্যে ঘটনার অন্য ২২ জন সাক্ষী হচ্ছেন শোয়েবুর রহমান গুলদার, আব্দুল কুদ্দুস মাতুব্বর, আবুল মেকার, সিদ্দিক মাতুব্বর, আবুল কালাম শরীফ, শহীদ পরিবারের সদস্য সন্তোষ কুমার মিত্র, শহীদজায়া নূরজাহান বেগম, শহীদ পরিবারের সদস্য মোজাম্মেল হক শরীফ, আহমেদ মিয়া, বিমল চন্দ্র ব্যাপারী, আব্দুস ছত্তার শরীফ, দিলীপ কুমার পাইক, জনপ্রসাদ পাইক, মহেন্দ্র অধিকারী, শহীদ পরিবারের সদস্য বকুল রানী হালদার, শহীদ পরিবারের সদস্য টিকেন্দ্রনাথ মজুমদার, বীরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, শহীদপুত্র দীপক কুমার বিশ্বাস, শহীদ পরিবারের সদস্য সন্তোষ কুমার খরাতী, মো. বাচ্চু আকন, কেশব চন্দ্র বিশ্বাস এবং বিধান চন্দ্র কীর্ত্তনীয়া।
আর জব্দ তালিকার সাক্ষী হচ্ছেন বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের (পিআইবি) ক্যাটালগার মো. রবিউল আনাম খান।
তাদেরকে জেরা করেছেন জব্বারের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান।
গত বছরের ১ ও ৩ ডিসেম্বর জব্বারের পক্ষে দুই কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান। অন্যদিকে গত বছরের ২৫ থেকে ৩০ নভেম্বর ও ৩ ডিসেম্বর চার কার্যদিবসে জব্বারের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল ও জাহিদ ইমাম।
জব্বারের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের শ্বশুর ছিলেন স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা। তিনি ১৯৫৬ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। আব্দুল জব্বার ১৯৭১ সালের আগে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে মঠবাড়িয়া থানায় রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। জব্বার ছিলেন থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। আত্মীয় ইস্কান্দার মৃধাকে তিনি রাজাকার কমান্ডার করেন।
জব্বারের নেতৃত্বে ও তার উপস্থিতিতে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি, নলী ও আঙ্গুলকাটা গ্রামে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয় বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের নেতৃত্বে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৬ মে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি গ্রামের দুই মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাক বিশ্বাস ও মোতালেব শরীফকে হত্যা করে। এছাড়া গ্রামের নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার আনুমানিক ১৬০টি বাড়িতে লুট এবং অগ্নিসংযোগ করে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৭ মে ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি গ্রামে আক্রমণ করে। তারা গ্রামের শারদা কান্ত পাইককে হত্যা এবং ৩৬০টি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ মে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের নিয়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার নলী গ্রামে আক্রমণ করেন। জব্বার নিজে তার হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন গ্রামের সাখানাথ খরাতীকে। জব্বারের নির্দেশে রাজাকাররা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে গ্রামের নিশিকান্ত বিশ্বাস ও তার ছেলে সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, জিতেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, গণেশ চন্দ্র মিস্ত্রি, উপেন্দ্র নাথ মিস্ত্রি, বসন্ত হালদার, বলরাম মিস্ত্রি, ষষ্ঠী হালদারকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন গ্রামের মোট ১১ জন শহীদ হন। রাজাকাররা গ্রামের ৬০টি বাড়ির মালামাল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তর সালের ১৬ মে তুষখালী হাইস্কুল মাঠে ইঞ্জিনিয়ার জব্বার মিটিং করেন। ওই মিটিংয়ে হিন্দুদেরকে তিনি ‘পাকিস্তানের শত্রু’ তাদের অর্থ-সম্পত্তিকে ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণায় রাজাকাররা ফুলঝুড়ি গ্রামের সাতটি বাড়িতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে। জব্বারের নির্দেশে রাজাকাররা গ্রামের প্রায় দুইশ’ নিরস্ত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তর করে এবং তাদের নাম পরিবর্তন করানো হয়।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার আঙ্গুলকাটা ও মঠবাড়িয়া গ্রাম থেকে ৩৭ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও তাদের মালামাল লুণ্ঠন করে রাজাকাররা। জব্বার ইঞ্জিনিয়ার তাদের মধ্য থেকে ৭ জনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন। বাকি ৩০ জনকে সূর্যমনি নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে জব্বারের নির্দেশে গুলি করা হয়। এ সময় ২২ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এবং ৮ জন গুরুতর আহত হন।
উভয়পক্ষ চান ন্যায়বিচার
প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম আব্দুল জব্বারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে বলেছেন, তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, আটক, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫টি অভিযোগের পক্ষে মোট ২৪ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। জব্বারের বিরুদ্ধে সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
পলাতক জব্বারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আবুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপক্ষে ২৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের সবাইকে জেরা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা ৫টি অভিযোগের মধ্যে কোনোটিতেই প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে তিনি জড়িত ছিলেন না।
এ কারণে সকল অভিযোগ থেকে জব্বার খালাস পাবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
পলাতক জব্বারের পরিবারের কেউ দেশে থাকেন না জানিয়ে তিনি বলেন, মামলার শুরু থেকে আমি জব্বারের নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেছি। মামলা পরিচালনায় তাদের অনীহা ছিল।
ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা রাষ্ট্রপক্ষের দলিলপত্র অনুসারে ইঞ্জিনিয়ার জব্বার আমেরিকায় অবস্থান করছেন বলেও জানিয়েছেন মো. আবুল হাসান।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৫
** জব্বারের যুদ্ধাপরাধের রায় মঙ্গলবার