ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগে নেত্রকোনার মো. ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীর বিরুদ্ধে অভিযোগ(চার্জ) গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাদের বিরুদ্ধে আগামী ৫ এপ্রিল প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহন শুরুর দিন ধার্য করা হয়েছে।
সোমবার (২ মার্চ) এ অভিযোগ গঠন করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। ননী ও তাহেরকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাদেরকে দোষী না নির্দোষ জিজ্ঞাসা করা হলে তারা নিজেদেরকে নির্দোষ বলে দাবি করেন।
এ সময় প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নী এবং আসামি ওবায়দুল হক তাহেরের পক্ষে অ্যাডভোকেট শাহ মোহাম্মাদ শাহাবুদ্দিন ও আতাউর রহমান ননীর পক্ষে অ্যাডভোকেট গাজী টিএইচ তামিম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
একটি মামলার আসামি ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননী অভিযুক্ত হয়েছেন হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, দেশান্তরিতকরণ, বাড়িঘরে আগুন ও লুটপাটের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে। এর মধ্যে রয়েছে ৪২ জনকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা-গণহত্যা, দুই পরিবারকে বাড়ি দখল ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে দেশান্তরিতকরণ এবং প্রায় সাড়ে ৪শ’ বাড়ি ঘরে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ। তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে থাকা চারটি অভিযোগ থেকে দু’টি বাড়িয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে (ফরমাল চার্জ) ছয়টি অভিযোগ দাখিল করেছিলেন প্রসিকিউশন। ওই ছয়টি অভিযোগকেই আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
গত ১৮ জানুয়ারি ননী-তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহসান বাদল। অন্যদিকে ২৬ জানুয়ারি অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে আসামিপক্ষে শুনানি করেন ননীর আইনজীবী শাহ মোহাম্মাদ শাহাবুদ্দিন ও তাহেরের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম।
তাহের ও ননীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেবেন রাষ্ট্রপক্ষের ৩২ জন সাক্ষী।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ননী-তাহেরের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ৪ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউশন।
গত বছরের ৫ নভেম্বর ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীর বিরুদ্ধে ৬৩ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
মামলাটি তদন্ত করেছেন তদন্ত সংস্থার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবীর। গত বছরের ৬ জুন থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত তদন্ত চালিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
৯ নভেম্বর এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় প্রসিকিউশনে। এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরি করেন প্রসিকিউশন।
গত বছরের ১২ আগস্ট ননী ও তাহেরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল-১। এর পর পরই নেত্রকোনা পৌর শহর থেকে মোক্তারপাড়া এলাকার সাবেক ফুটবলার আতাউর রহমান ননী ও তেরীবাজারের ব্যবসায়ী ওবায়দুল হক তাহেরকে গ্রেফতার করে নেত্রকোনা মডেল থানা পুলিশ। পরে গ্রেফতারকৃত দু’জনকে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তরের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।
১৩ আগস্ট ননী ও তাহেরকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো ও তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ২৫ আগস্ট প্রসিকিউশনের আবেদনক্রমে ননী ও তাহেরকে একদিন করে সেফহোমে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিলে তদন্তের স্বার্থে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধা আলী রেজা কাঞ্চন বাদী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত দু’জনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করেন।
ননী-তাহেরের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
অভিযোগে বলা হয়েছে, ওবায়েদুল হক তাহের (৫৫) নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার ভোগাপাড়ার শুনই এলাকার মৃত মঞ্জুরুল হকের ছেলে। তিনি নেত্রকোনা পৌর শহরের তেরীবাজারে থেকে ব্যবসা করেন। অন্যদিকে আতাউর রহমান ননী (৫৮) একই জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কচন্দরা এলাকার মৃত আহছান আলী ওরফে আছান আলী ওরফে হাছেন আলীর ছেলে। ননী পৌর শহরের মোক্তারপাড়া এলাকার বাসিন্দা এবং একজন সাবেক ফুটবলার।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আসামিরা ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা’র বিশ্বাস থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করেন।
আসামি তাহের রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হলে অপর আসামি ননীসহ আরো অনেকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। এরপর শহরের মোক্তারপাড়ায় মলয় বিহারী বিশ্বাসের বাড়ি দখল রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করেন তারা।
তারা ১৯৭১ সালে নেত্রকোনা জেলার সদর এলাকা ও বারোহাট্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট তাহের ও ননীর নেতৃত্বে রাজাকাররা নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার বাউসী বাজার থেকে ফজলুল রহমান তালুকদারকে অপহরণ করে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় নিযাতনের পর ত্রিমোহনি ব্রিজে হত্যা করে। একই সঙ্গে ৪০০ থেকে ৪৫০টি দোকানের মালামাল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৪ অক্টোবর জেলার বারহাট্টা রোডের শ্রী শ্রী জিউর অাঁখড়ার সামনে থেকে তাহের ও ননী কৃতী ফুটবলার দবির হোসেনকে অপহরণ করেন। পরে নির্যাতনের পর মোক্তারপাড়া ব্রিজে গুলি করে হত্যা করা হয় দবিরকে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর তাহের ও ননীর নেতৃত্বে বারহাট্টা থানার লাউফা গ্রাম থেকে মশরফ আলী তালুকদারসহ ১০ জনকে অপহরণ করে ঠাকুরাকোনা ব্রিজে নিয়ে ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ননী ও তাহের মলয় বিশ্বাস ও অ্যাডভোকেট শীষ চন্দ্র সরকারের বাড়ি দখল করে মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে পরিবারসহ তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৫ নভেম্বর তাহের ও ননী বিরামপুর বাজার থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বদিউজ্জামান মুক্তসহ ৬ জনকে অপহরণ করে লক্ষীগঞ্জ খেয়াঘাট ও মোক্তারপাড়া ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, তাহের ও ননী চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামিনী চন্দ্র চক্রবর্ত্তীসহ ২৭ জনকে নেত্রকোনা জেলগেট থেকে আটক ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০১৫