ব্রাহ্মণবাড়িয়া: কুল্লাপাথরে ৫০ শহীদের সমাধিস্থলের প্রথম সারিতেই তার কবর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে গোলাবারুদ নিয়ে আসার পথে পাকিস্তানিদের আর্টিলারি শেলে মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল ৪৫ বছর বয়সী কৃষক আব্দুল জব্বারের।
দেশের জন্য এভাবে প্রাণ দিয়ে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ আব্দুল জব্বারের।
কসবার ভারত সীমান্ত ঘেঁষা বায়েক ইউনিয়নের জয়দেবপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জব্বারের শেষ ঠিকানা হয় ছায়াঘেরা কুল্লাপাথরের শহীদ সমাধিস্থলে। ওই সমাধিস্থলে নয়টি সারিতে মোট ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন করা হয়।
রোববার (২২ মার্চ) সরেজমিনে কুল্লাপাথর গিয়ে দেখা যায়, কবরটির পাশে বসে ঢুকরে কাঁদছেন তার ছেলে খোকন মিয়া (৫৫)।
চোখের পানি মুছতে মুছতে খোকন মিয়া জানান, তিনি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সালদা নদীতীরের ওই এলাকায় তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। তারা জয়দেবপুর গ্রামের বাড়িঘর ছেড়ে কুল্লাপাথরে শরণার্থী হয়ে আসেন। সেদিন বিকেলেই খবর পান আর্টিলারি শেলে তার বাবা মারা গেছেন।
পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে জানতে পারেন, তার বাবা ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কোনাবন থেকে গুলির বাক্স মাথায় করে রওয়ানা হন কসবার মন্দভাগ স্টেশন সংলগ্ন মুক্তিবাহিনীর বাংকারের উদ্দেশ্যে। সকালে কুটি-চৌমুহনী এলাকায় আসার পর পাকিস্তানিদের আর্টিলারি শেল হামলার শিকার হন তিনি। ওই হামলায় তার মাথার খুলি উড়ে যায়। সঙ্গে থাকা আরও তিনজন মুক্তিযোদ্ধাও এই হামলায় প্রাণ হারান।
খোকন মিয়া জানান, কুল্লাপাথর গ্রামের আব্দুর রউফ মাস্টার (বর্তমানে ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার) দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করেন। সেই তালিকায় নাম না রাখায় মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন তার বাবা। কিন্তু কি কারণে তার বাবার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি সে প্রশ্নের উত্তর তারা আজও পাননি।
খোকন মিয়া বাংলানিউজকে জানান, চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার বড় ভাই বাচ্চু মিয়াসহ (৬০) ছোট দুই ভাই হারুন মিয়া এবং মনু মিয়াও কৃষিকাজ করেন। বাবার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেতে তারা অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
২০১১ সালের দিকে তৎকালীন কসবা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার আজিজ মিয়া কিছু কাগজপত্র তৈরি করে তাকে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু এরপর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আবেদন করলেও কারো সহানুভূতি পাননি শহীদ পুত্র খোকন মিয়া।
খোকন মিয়ার বড় ভাই বাচ্চু মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, বাবার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় এ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। যারা ভুয়া তারা তো ঠিকই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কেন আমার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না?
কুল্লাপাথরে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় শহীদদের সমাধিস্থ করা এবং এখনও পর্যন্ত সমাধিস্থলের তদারকির দায়িত্ব পালন করা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম বলেন, ১৯৭১ সালে আব্দুল জব্বার অদম্য সাহসিকতা দেখিয়েছেন, নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে- তিনি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। এটা কি শহীদ আব্দুল জব্বারের প্রতি অবমূল্যায়ন নয়?
বায়েক ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুর রউফ মাস্টার বলেন, মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেতে আবেদন করা হয়েছে। আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে মূল্যায়ন করা হবে।
তবে এ বিষয়ে জানতে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শহীদ জব্বারের ছেলে খোকন মিয়ার সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তারা অনলাইনে আবেদন করেছেন। আবেদনের বিপরীতে চলতি মাসের ২৮ মার্চ এবং আগামী এপ্রিলের ৪ ও ১১ তারিখে মন্ত্রণালয় কর্তৃক যাচাই-বাছাই হওয়ার কথা। যাচাই-বাছাই শেষে এ বিষয়ে একটা সমাধান পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৫