ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মাঘ ১৪৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

মুজিবনগর কমপ্লেক্স

মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক ৪০ পদে নিয়োগ হয়নি লোকবল

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৫
মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক ৪০ পদে নিয়োগ হয়নি লোকবল

মেহেরপুর: ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রসিদ্ধ মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রথম রাজধানী স্থাপিত হয়, এবং ১৭ এপ্রিল এখানেই অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে।
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্থায়ী সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।

ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে মিল রেখে এ স্থানের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর।

পরবর্তীকালে এখানে আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ ‘‘স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ’’ নির্মাণ করা হয় এবং বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ঐতিহাসিক স্থানটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রসহ ‘‘মুজিবনগর কমপ্লেক্স’’ নামে একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।

‘‘স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ’’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবময় ঐতিহ্যকে লালন করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রসহ মুজিবনগর কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক গৌরবোজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠবে।

ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আওতাধীন ৪০টি পদ সৃষ্টি করে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়। অল্প দিনের মধ্যে লোকবল নিয়োগ করার তাগিদ দেয় সরকার। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও আজো লোকবল নিয়োগ দিতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কোটি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত মুজিবনগর কমপ্লেক্সের বিভিন্ন স্থাপনা এখন অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।

এদিকে, নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার প্রায় ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও  মেহেরপুরের মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। যদিও একাধিকবার সময় বাড়ানোয় ব্যয় বেড়েছে। যেটুকু কাজ হয়েছে, তাও লোকবল ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে।  

৪২ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা মুজিবনগর কমপ্লেক্সে প্রতিদিন শতাধিক দর্শনার্থী আসেন। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান বলে এখানে আসেন প্রতিবেশী ভারতের মানুষসহ বিদেশিরাও। কিন্তু অসম্পূর্ণ প্রকল্প দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। এখানে কোনো খাওয়া দাওয়া, এমনকি পানি পানেরও ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো শৌচাগার বা বিশ্রাম নেওয়ার ছাউনি।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সীমান্তঘেঁষা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ বাবুর আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। পরে ওই জায়গার নাম দেওয়া হয় মুজিবনগর। ঐতিহাসিক ওই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালে এ প্রকল্প হাতে নেয়।

১৯৯৮ সালের জুন মাসে ৪৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০০৬ সালে তা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এরপর সময় বাড়িয়ে ২০১০ ও পরে আবার ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৪৭ কোটি সাত লাখ টাকা।

মেহেরপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া খণ্ড খণ্ড অর্থ ব্যয়ে প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ মন্ত্রণালয় প্রকল্পের তদারক করছে। তাই ২০০১ সালের আগে কত টাকায় কোন কাজ হয়েছে, তার পরিসংখ্যান কেউ জানাতে পারেননি।

আহসান উল্লাহ জানান, মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রের মধ্যে গণপূর্তের অধীনে যতটুকু কাজ ছিল, তার প্রায় ৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বেশ কিছু কাজ বাকি আছে। ওই কাজ শেষ করতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ কোটি ৬৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। টাকা পেলে আবার কাজ শুরু হবে।

পর্যটন মোটেলের বর্তমান অবস্থা:

মুজিবনগর দিবসের সময় খোলা থাকলেও বছরের অন্য সময় বন্ধ থাকে পর্যটন মোটেল। দুই কোটি টাকার আসবাব কেনা হয়েছে এই মোটেলের জন্য।

গণপূর্ত বিভাগ জানায়, মোটেলে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে একটি ৭৫ কেভিএ জেনারেটর, ১৫টি এসি, চারটি রেফ্রিজারেটর, ১২টি গ্রিজার, আটটি টেলিভিশন, ২৪টি গার্ডেন লাইট ও দু’টি পানির পাম্প।

এসব যন্ত্রপাতির অবস্থা জানতে চাইলে প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ বলেন, ‘তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে এগুলো পড়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়নি। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি অনেক দিন পড়ে থাকলে নষ্ট হতেই পারে। সংযোগ দেওয়ার পর বোঝা যাবে কোনটা সচল কোনটা অচল। ’

পাকিস্তানি সেনার ভাস্কর্যের ডান হাতে থাকা মশাল ভেঙে গেছে ২০০০ সালে। একটি শপিং মল তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। আজ পর্যন্ত সেখানকার আটটি দোকান তালাবদ্ধ। অথচ স্মৃতিকেন্দ্রে ঢুকতেই রাস্তার ডান পাশে বেশ কয়েকটি অবৈধ দোকান বসেছে।

প্রকল্পে একটি ফোয়ারাও আছে। কিন্তু তাতে নেই পানি ও বিদ্যুৎ-সংযোগ। ফোয়ারার রেলিংয়ের অনেক অংশ ভেঙে গেছে। এর দুই পাশে দু’টি গোলাপ বাগান। দেখা গেল বাগানের বেশির ভাগ গাছ মৃত। ১৯৯৯ সালে বন বিভাগ এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই বাগান তৈরি করে।

প্রকল্পে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আটটি গুরত্বপূর্ণ ঘটনার ওপর সাদা সিমেন্টে তৈরি সুদৃশ্য ভাস্কর্য। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় প্রতিটি ভাস্কর্যে ময়লা জমেছে। জায়গায় জায়গায় চিড় ধরেছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার ভাস্কর্যটির উঁচিয়ে ধরা ডান হাতের আঙুলে দেখা দিয়েছে ফাটল।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানীর পায়ের কাছে ভিতে ফাটল ধরেছে। ভাস্কর্যগুলো পার হলেই প্রায় ১৩ হাজার ৩৫৫ বর্গমিটার জমির ওপর মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভিত্তিক বাংলাদেশের বিশাল মানচিত্র। এর দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের আদলে কৃত্রিম লেক। মানচিত্রের বিভিন্ন স্থানে আগাছা জন্মেছে। পানিতে ময়লা-আবর্জনা জমে একাকার। মানচিত্রের চারদিকে বৃত্তাকারে নির্মিত গ্যালারিতে ম্যুরাল ও ক্ষুদে ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা।

গ্যালারির সুইচবোর্ডগুলোও ভাঙা। বেশ কিছু হ্যালাউড লাইট ভেঙে ঝুলে পড়েছে। কবুতরের বিষ্ঠায় নোংরা হয়ে আছে অনেক জায়গা। গ্যালারির ছাদের বেশ কিছু স্থান ও সিঁড়িতে ওঠার একটি দেয়ালেও ফাটল ধরেছে।

প্রকল্পের প্রশাসনিক ভবন ও একটি জাদুঘরের কাজ ২০০৫ সালেই শেষ হয়েছে। জাদুঘরে একটা ঘরের মধ্যে কোনোরকমে রাখা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, উপ-প্রধান, সেক্টর কমান্ডার, সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও বীর প্রতীক খেতাব পাওয়া দুই নারী মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। জাদুঘরের পাশে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে একটি ২০ কেভিএ জেনারেটর ও ১৩টি এসি।

২০১১ সালে নির্মাণ করা হয় এক হাজার ৬০ বর্গমিটার আয়তনের ৪শ’ আসনের একটি মিলনায়তন। তবে স্টেজের কাঠের কাজ, জল ছাদসহ বেশ কিছু কাজ এখনো বাকি। নতুন প্রকল্পে ওই সব কাজ শেষ করতে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। মিলনায়তন চালু না হওয়ায় অব্যবহূত অবস্থায় রয়েছে অত্যাধুনিক স্টেজ লাইটিং সিস্টেম, সাউন্ড সিস্টেম, ১২ দশমিক ৪ টন করে ছয়টি এয়ারকুলার, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ইত্যাদি।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রের অসমাপ্ত কাজের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘প্রকল্পটির কাজ শেষ করার ব্যাপারে আমরা খুবই আন্তরিক। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।