ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

চাচাকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেন সিরাজ মাস্টার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১৫
চাচাকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেন সিরাজ মাস্টার

ঢাকা: রাজাকাররা তাদের হাতে থাকা ছোরা ও বেয়নেট দিয়ে আমার চাচা কাঞ্চন শেখসহ আটককৃত ১৯ জনকে নির্যাতন করে। সিরাজ মাস্টার ছোরা দিয়ে কোমরে ঘা দিলে চাচা কাঞ্চন শেখ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

তখন সিরাজ মাস্টার বেয়নেট দিয়ে তাকে জবাই করেন।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে এসব কথা বলেছেন শহীদ পরিবারের সদস্য আহমেদ আলী শেখ। তিনি সিরাজ মাস্টার, লতিফ তালুকদার ও খান আকরামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ২৫তম সাক্ষী।

বুধবার (৪ মার্চ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন আহমেদ আলী শেখ। সাক্ষ্যগ্রহণে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান।

বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে ২৬তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
 
বর্তমানে আনুমানিক ৬৩ বছর বয়সী সাক্ষী আহমেদ আলী শেখ বাগেরহাট সদর উপজেলার কান্দাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল আনুমানিক ১৯ বছর। সে সময় তিনি পাকিস্তান মুজাহিদ (আনসার) বাহিনীর সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনি পূবালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। বর্তমানে অবসরে আছেন।

সাক্ষ্যে আহমেদ আলী শেখ বলেন, ১৯৭১ সালের ১৮ জুন সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা আমার চাচা কাঞ্চন শেখকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। সেদিন সিরাজ মাস্টারসহ রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা চাচা কাঞ্চন শেখসহ গ্রামের মোট ১৯ জনকে ধরে কান্দাপাড়া বাজারের দিকে নিয়ে যায়।

‘রাজাকাররা তাদের হাতে থাকা ছোরা ও বেয়নেট দিয়ে আটককৃতদের নির্যাতন করে। আসামি সিরাজ মাস্টার ছোরা দিয়ে কোমরে ঘা দিলে চাচা কাঞ্চন শেখ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন সিরাজ মাস্টার বেয়নেট দিয়ে তাকে জবাই করেন,’—সাক্ষ্যে বলেন তিনি।  

সাক্ষী আহমেদ আলী বলেন, সিরাজ মাস্টারের নির্দেশে রাজাকাররা ধরে আনা অন্যদের ছোরা দিয়ে হত্যা করেন।
চাচার খোঁজ করতে এসে কান্দাপাড়া বাজারের কাছে ঝোঁপের আড়াল থেকে তিনি এ ঘটনা দেখেন বলে উল্লেখ করেন একাত্তরে শহীদ কাঞ্চন শেখের ভাতিজা আহমেদ আলী।  

তিনি জানান, সেখানে (ঝোঁপে) আগে থেকেই আমার বড় ভাই মোহাম্মদ আলী শেখসহ অনেকেই লুকিয়ে ঘটনাটি দেখেছেন।
সাক্ষে আহমেদ আলী শেখ বলেন, ধরে আনা ১৯ জনকে হত্যার পর সন্ধ্যার কিছু আগে বাজারের দু’টি দোকানে লুটপাট চালানো হয়। পরে এসব দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয় রাজাকাররা।  

‘সেদিন আমার চাচা কাঞ্চন শেখের সঙ্গে আরও যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আব্দুল আলী, মকবুল আলী এবং সবুরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম’—যোগ করেন তিনি।
 
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও ২৪ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন দিলীপ দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, শহীদজায়া কমলা রানী চক্রবর্তী, তপন কুমার দাস, শহীদপুত্র অরুণ দাস, শহীদপুত্র নন্দলাল দাস, নিমাই চন্দ্র দাস, শহীদপুত্র আনন্দ লাল দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজর আহমেদ, শহীদপুত্র সোবহান শেখ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব নকিব।

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন।

গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজাকার কমান্ডার ‘বাগেরহাটের কসাই’ বলে কুখ্যাত সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং তার দুই সহযোগী আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খাঁনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে ৩টি করে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের শাঁখারিকাঠি বাজার, রনজিৎপুর, ডাকরা ও কান্দাপাড়া গণহত্যাসহ ৮ শতাধিক মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন। অন্যদিকে ৩০ সেপ্টেম্বর ও ২০ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের পক্ষে তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর সরোয়ার হোসেন এবং শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের পক্ষে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল হাসান।

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিসে প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন ও শেখ মুশফিক কবির তাদের বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।

তদন্ত চূড়ান্ত করে গত বছরের ২৫ আগস্ট এ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করেন তদন্ত সংস্থা। তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত দল দীর্ঘ তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে এ চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রসিকিউশন এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
 
বাগেরহাটের এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ ৯টি ভলিউমে ৫ খণ্ডে কেস ডায়েরি করে অভিযোগ দাখিল করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ৯টি খণ্ডে মোট ৮শ’ ৪৪ পৃষ্ঠার তদন্তের ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ৬৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন তদন্ত সংস্থা।

ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছরের ১০ জুন এ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১১ জুন আব্দুল লতিফ তালুকদার, ১৯ জুন আকরাম হোসেন খাঁন ও ২১ জুলাই সিরাজ মাস্টারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
 
তাদেরকে সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় এ তিনজনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।