বগুড়া: মাঝখানে আইল। এপাশে-ওপাশে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত।
একপাশে চলছে নতুন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম। কাস্তে হাতে চলছে কৃষকের লড়াই। কাটার পাশাপাশি আটি বাঁধাও চলছে সমান তালে। দড়িতে সেই আটি স্তূপ আকারে বেঁধে লাগানো হচ্ছে বাঙের (স্থানীয় ভাষায়) দুই মাথায়। পরে কাঁধে উঠিয়ে বাঙ ঝুলাতে ঝুলাতে ধান পৌঁছে যাচ্ছে কৃষকের উঠানে।
সেখানে ভুত (স্থানীয় ভাষায়) মেশিনে চলছে মাড়াইয়ের কাজ। এ প্রক্রিয়ায় খড় থেকে ধান আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সামান্য ময়লা আবর্জনা থাকলে তাও পরিষ্কার করে নিচ্ছেন কৃষক। সঙ্গে কৃষাণীও পরিষ্কারের কাজটি করছেন। এরপর বিক্রির জন্য ধান বস্তায় ভরে, বাকিটা তোলা হচ্ছে গোলায়।
আরেকপাশে চলছে নীরব কান্না। দেখা দিয়েছে নানা রোগবালাই। ফসল ঘরে তোলার আগমুহূর্তে এসে কারেন্ট ও মাজরা পোকা, পাতা ঝলসানো ও খোলপচা রোগের আক্রমন কৃষকদের দিশেহারা করে তুলেছে।
এসব রোগবালাই দমনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে মাইকযোগে প্রচারণা চালানো হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। মাইকযোগেই কৃষকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বিতরণ করা হচ্ছে লিফলেট। পাশাপাশি আক্রান্ত এলাকাগুলোতে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একাধিক টিম।
বৃহস্পতিবার (২২অক্টোবর) উত্তরাঞ্চলের শস্য ভাণ্ডারখ্যাত বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে চলতি মৌসুমের রোপা-আমন ধান সম্পর্কে এ তথ্য ওঠে আসে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বগুড়া অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলের চার জেলার চলতি মৌসুমে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এসব জাতের মধ্যে ব্রি ধান-৩৯, ৩৩, ৩৪, ৫১, ৫২, ৬২, বিনা-৭, বিআর-১১ অন্যতম।
বগুড়া জেলায় ১ লাখ ৭৭ হাজার ২৬৮ হেক্টর, জয়পুরহাটে ৭০ হাজার ৭২৩ হেক্টর, পাবনায় ৫১ হাজার ৩৫০ হেক্টর ও সিরাজগঞ্জে ৫৯ হাজার ১৯১ হেক্টর জমিতে এসব জাতের ধান লাগানো হয়েছে।
আলী আকবর, সোলাইমান আলী, রফিকুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, নাজমুল হক, মোজাম্মেল হক, জাহিদুল ইসলাম -সবাই নন্দীগ্রাম উপজেলার কৃষক।
তারা বাংলানিউজকে জানান, এবার এ উপজেলার অসংখ্য কৃষক ব্রি ধান-৬২ ও বিনা-৭ ধান চাষ করেন। বর্তমানে তারা ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাশাপাশি এসব জমিতে আলু ও সরিষা চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলনও বেশ ভালোই হয়েছে। ব্রি-৬২ ধান বিঘাপ্রতি ১৩-১৪মণ হারে আর বিনা-৭ জাতের ধান ১৫-১৬ মণ হারে ফলন হয়েছে।
তবে শেষ মুহূর্তে এসে অনেক কৃষকের ধান ক্ষেতে রোগবালাই দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার পরিমানও একেবারে কম নয়। স্বভাবতই সেসব কৃষক ভালো নেই। ক্ষেতের ফসল রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু শেষ পরিণতি দেখতে আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে তারা জানান।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা মুশিদুল হক বাংলানিউজকে জানান, কিছু জমিতে রোগবালাই দেখা দিলেও বর্তমানে তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
অনুকূল আবহাওয়া ও কৃষি অধিদফতর কর্মকর্তাদের আগাম দিকনির্দেশনায় কৃষক যথাসময়ে রোগবালাই দমন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।
শেরপুর উপজেলার বরেন্দ্রখ্যাত মির্জাপুর, বিশালপুর, ভবানীপুর, কুসুম্বী ও শাহবন্দেগী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করা হয়েছে।
সরেজমিনে কথা হয় কৃষক ইকবাল হোসেন, শহিদুল ইসলাম, আবু সাঈদ, গোলাম রব্বানী, ফজলুল করিম, রেজাউল হক বাবলু, মতিউর রহমান, তমিজ উদ্দিনের সঙ্গে।
তারা জানান, তাদের অনেক জমির ফসল ভালো আছে। অনেক জমির ধান কাটা হচ্ছে। এর মধ্যে আবার অনেক জমিতে শুরুতে মাজরা পোকা আক্রমণ করে। ওষুধ প্রয়োগে সে সমস্যা দূর হলেও, দেখা দেয় কারেন্ট পোকার আক্রমণ। এছাড়া পাতা ঝলসানো ও খোলপচা রোগতো লেগেই আছে। এসব রোগবালাই দমনে ওষুধ প্রয়োগে কোনো কাজ হচ্ছে না।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে জানান, রোগবালাই দমনে করণীয় বিষয়ে গ্রামে গ্রামে মাইকযোগে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের মাঝে গণসচেতনতা বাড়াতে সভা-সমাবেশ ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক মাঠপর্যায়ে কাজ চলছে। সবমিলে রোগবালাইয়ের আক্রমন এখন অনেক কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বগুড়া অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ জাহিদ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বৃহত্তর এ অঞ্চলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। এছাড়া ৮০ শতাংশ জমির ফসল সম্পূর্ণ ভালো আছে। অবশিষ্ট জমিতে রোগবালাইয়ের আক্রমন দেখা দিলেও সেটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তাই এ বছর রোপা-আমনের সুপার বাম্পার ফলনের আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৫
এমবিএইচ/আরএম