ঢাকা: ব্যবধান মাত্র ১৩ দিন। তবে ধরন অভিন্ন।
বুধবারের অপারেশনে ধারালো অস্ত্রের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করেছে ঘাতকরা। ঘটনাস্থলে পাওয়া দুটি ব্যবহৃত গুলির খোসা থেকে এই ধারণা পুলিশের।
তবে হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ধরনে পুলিশ নিশ্চিত, উগ্রপন্থি গোষ্ঠীই এই হামলায় জড়িত। কিন্তু কিলিং মিশনে কারা ছিলো তা এখনো অজানা তদন্তকারীদের। ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের আশপাশের কোনো প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ রয়েছে কিনা তার খোঁজ চলছে। পাশাপাশি ওই স্থান ও আশপাশের এলাকায় ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের সন্দেহজনক তালিকা ধরেই সংগ্রহ করা হচ্ছে কল ও ভয়েজ ডাটা রেকর্ড।
দিনের ব্যস্ততা শুরুর আগে আগে একটি বিনোদন পার্কের সামনে এভাবে হামলা হতে পারে তা কখনো ভাবনাতেই আনেনি পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দায়িত্বের পালাবদলের মুহৃর্তে শক্তপোক্ত নয়, বেশ নড়বড়ে অবস্থানেই ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। প্রতিরোধ দূরের কথা, আত্মরক্ষার্থে গুলি পর্যন্ত ছোঁড়েননি আক্রান্তরা।
বুধবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে আশুলিয়ার বারইপাড়ার অদূরে নন্দন পার্কের সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে পুলিশের একটি চেকপোস্টে এ ঘটনা ঘটে।
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) একরাম হোসেন জানান, সহযোগী হিসেবে শিল্প পুলিশের একটি দল নন্দন পার্কের সামনের চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলো। একটি মোটরসাইকেলে করে দুই যুবক কালিয়াকৈরের দিক থেকে নবীনগরের যাবার পথে পুলিশ সদস্যরা মোটরসাইকেলটিকে থামান। সেটির কাছে যাওয়া মাত্রই হামলাকারীরা দুই পুলিশকে বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ছুরিকাঘাত করেন। আহত অবস্থায় মুকুল ও নূর আলম দৌড়ে নন্দন পার্কের বিপরীত দিকে গজারী বনের পাশে শুভেচ্ছা হোটেল ও রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েন। পরে ওই দুই যুবক পিছু পিছু এসে ওই হোটেলে ঢুকে আবারও তাদের ছুরিকাঘাত ও গুলি করে। এরপর কয়েকটি ফাঁকাগুলির শব্দ শোনা যায়। পরে নির্বিঘ্নে যুবকরা ত্যাগ করে ঘটনাস্থল। গুরুতর আহত দুই পুলিশ সদস্যকে স্থানীয়রা ফাতেমা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মুকুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
তবে শিল্প পুলিশের আশুলিয়া অঞ্চলের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা শিল্প পুলিশ-১ এর উপ পরিচালক কাওসার শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, কিলিং মিশনে দুই জনের অধিক সদস্য ছিলো। তারা ৫ সদস্যের পুলিশের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। চেষ্টা চালায় তাদের অস্ত্র ছিনতাইয়ের। বিষয়টি এলার্মিং- যোগ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
আশুলিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান জানান, কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে এসে দুর্বৃত্তরা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। এতে কনস্টেবল মুকুল হোসেন ও নূরে আলম সিদ্দিক মারাত্মক জখম হন। বাকিরাও আঘাত পান। তবে সহকর্মীদের ওপর অতর্কিতে হামলার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অপর তিন কনস্টেবল আপেল, পিনহারুল ইসলাম ও ইমরান
ছুটে যান দ্বিগবিদিক।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম রফিকুল ইসলাম জানান, মুকুলের ঘাড়ে, বুকে, পেটে উপুর্যপরি ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। তাকে চিকিৎসার কোন সুযোগ মেলেনি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মৃত্যু হয় মুকুলের। অন্যদিকে নূরে আলম সিদ্দিকের পেটে, মুখে ও বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার বাম হাতটি রক্ষার চেষ্টায় চিকিৎসকদের একটি দল অস্ত্রপচার করছিলেন।
সদ্য বিবাহিত মুকুল হোসেন পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন ২০১২ সালে। তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বাহুবল গ্রামের শহিদুল ইসলামের পুত্র।
কারা ঠিক কি উদ্দেশে হামলা চালিয়েছে তা এখনো নিশ্চিত নয় পুলিশ। তবে ইতোপূর্বে সংঘঠিত ঘটনাগুলোর সঙ্গে এই হামলার যোগসূত্র যে রয়েছে সে ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত তদন্তকারীরা।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, উগ্রপন্থি গোষ্ঠী যে এই হামলা চালিয়েছে তা
ধরন দেখে আমরা নিশ্চিত। আমরা কাজ করছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যেই হামলাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ছোপ ছোপ রক্ত। ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে পুলিশ। ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা সংগ্রহ করছেন গুরুত্বপূর্ণ আলামত। হামলাকারী ঘাতকদের সম্পর্কে ধারণা পেতে আশপাশের এলাকার মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ।
এরই মধ্যে দুপুরে আহত পুলিশ সদস্যকে দেখতে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পরে তিনি হাসপাতালটির কনফারেন্সরুমে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীসহ উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখী হন তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের রায় বাস্তবায়নের কার্যক্রম নস্যাৎ করতে এ ধরনের হামলা চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে ব্লগার-প্রকাশকদের উপর যেভাবে হামলা হয়েছে, পুলিশের উপর হামলা হয়েছে একই কায়দায়।
মন্ত্রী বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ শিগগিরই দল গঠন করে জড়িত জঙ্গিদের ধরার কাজ শুরু করবে। এরা মানবতার শত্রু, মানুষের শত্রু। নৃশংসভাবে এরা ছুরিকাঘাত করে পুলিশকে হত্যা করেছে। চেঞ্জিং আওয়ারে এই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই হামলা হয়।
এ সময় ভারপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধানকে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
হামলাগুলোর ধরন এক। ব্লগার-প্রকাশকদের উপর যেভাবে হামলা হয়েছে সেই একই কায়দায় আশুলিয়ায় পুলিশের উপর হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা কখনো হরকাতুল জিহাদ, কখনও আনসারুল্লাহসহ নানা নাম ব্যবহার করলেও আসলে এক। আমরা সবকটি হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করছি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী বসে নেই। পুলিশ কাজ করছে। -যোগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এর আগে দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে গত ২২ অক্টোবর রাতে গাবতলী সেতুর কাছে পর্বত সিনেমা হলের সামনে পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকিতে একই ধরনের হামলা হয়।
সেখানে এক যুবকের ছুরিকাঘাতে ইব্রাহিম মোল্লা (৪০) নামে পুলিশের এক এএসআই নিহত হন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
জেডএম