ঢাকা: চার মাসের ফুটফুটে শিশুটির এতো রাতে বিছানায় শুয়ে শুধু তার বাবা-মাকে দেখার কথা, তাদের বুক ভরিয়ে রাখার কথা। অথচ মধ্যরাতে হাসপাতালের সামনে মাইক্রোবাসের ভেতরে শিশুটি, মায়ের কোলে শান্তির পরশে।
উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর সড়কের সেন্ট্রাল ক্লিনিকের ঠিক সামনে একটি মাইক্রোবাসে সোমবার (৯ নভেম্বর) দিনগত রাত ২টায় তারা বসে আছেন। গাড়িতে তাদের পাশের সিটে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছেন গর্ভধারিণী-মমতাময়ী মা। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে শফিকুল ইসলামের (২৯) সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ার খবর শুনেই হাসপাতালে ছুটে এসেছে পুরো পরিবার।
সান্ত্বনা দিতে তাদের জানানো হয়, শফিকুল নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন। এখন দেখা করা যাবে না। তাই গাড়িতে বসে থাকতে হবে।
আসলে ঘটনাস্থলেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে তাদের ছেলে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শফিকুলের। সোমবার (৯ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর চত্বরের সামনে একটি বাসকে আরেকটি বাস ধাক্কা দিলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে প্রাণ যায় তার।
গাড়ি থেকে স্ত্রী বলে উঠেন, ‘চার মাস আগে আমিও তো আইসিইউতে ছিলাম, সেখানে মানুষ তো দেখতে যেতে পারে। আমাকে একবার যেতে দাও’।
কিন্তু কেউ তাকে যেতে দিচ্ছেন না। অজানা শংকায় বুক ফেটে যাচ্ছে স্ত্রী আয়েশা আক্তারের… কেমন আছেন তার স্বামী? এই উত্তর কার কাছ থেকে জানবেন তিনি?
ফুটফুটে শিশু কোলে নিয়ে বসে থাকা তরুণীর স্বামীর মৃত্যু সংবাদটি পৌঁছানোর কঠিন কাজটি কারও পক্ষেই যেন সম্ভব হচ্ছে না।
অবশেষে বুকে পাথর বেঁধে মৃত্যু সংবাদটি ছেলের প্রিয়তমা স্ত্রী আর জন্মদাত্রী মাকে জানানোর দায়িত্ব নিলেন বৃদ্ধ বাবা নিজেই।
আড়ালে ডুকুরে কেঁদে এসে এবার মাইক্রোবাসের পাশে বেশ শক্তভাবে দাঁড়ালেন বাবা মো. মোজাম্মেল হক সাজিদ। কিন্তু না, বলতে পারলেন না, যে কথা বলতে এসেছিলেন।
আবারও মিথ্যে বানিয়ে বলা শুরু করলেন, ‘ছেলে আইসিইউতে আছে, সুস্থ হলেই আমরা নিয়ে যাবো। ’ সঙ্গে সঙ্গে আবার কথার খেই হারিয়ে বলে ফেললেন, ‘পোস্টমর্টেম হলেই আমরা বাড়ি নিয়ে যাবো, সেখানে জানাজা হবে…!’
কেঁপে উঠে স্ত্রী জান্নাতুুল মাওয়ার বুক, শুরু হয় মায়ের গগণবিদারী আহাজারি… সরে যেতে থাকেন পিতা… যেন তার পায়ের তলা থেকেও মাটি সরে যাচ্ছে।
মায়ের বুকের ধন, নাড়িছেঁড়া সন্তানের জন্য এ আহাজারির কোনো সান্ত্বনা নেই। স্ত্রীর নয়নের জলে ভারি হয়ে গেছে উত্তরার সড়ক, শোকের আবহে ঘেরা বেদনায় মুহ্য হাসপাতালের একটি মধ্যরাত।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে তখন হৃদয় বিদারক এমন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলানিউজের প্রতিবেদক।
সন্তানহারা মাকে আর স্বামীহারা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে এসেছেন নিহত পুলিশ সদস্যের সহকর্মীরা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিলেন শফিকুল। বের হওয়ার আগে সহকর্মী জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তখন বিমানবন্দরের ভেতরে জয়নালের ডিউটি শুরু হয়েছে।
এএসআই শফিকুল তখন ফিরছেন উত্তরখানের বাসার দিকে। কিন্তু সে যাওয়া যে বাড়ির পথে নয়, চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া সেটা কে জানতো।
সদরঘাট-গাজীপুর রুটের ঘাতক সুপ্রভাত পরিবহনের বাস আর সায়েদাবাদ-গাজীপুর রুটের বলাকা পরিবহনের বাসের ধাক্কাধাক্কিতে প্রাণ যায় শফিকুল ইসলামের। বিমানবন্দরের সামনের মোড়ের পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত কয়েকজনকে প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শফিকুলের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে। তবে দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা জেলার উত্তরখানের মুন্ডা হাবিবনগর গ্রামে (হোল্ডিং নং ৮২) বাবা-মা-স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছিলেন তিনি।
বিমানবন্দর থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) বিকাশ চন্দ্র বাংলানিউজকে জানান, গাড়ির পেছনের সিটে বসা ছিলেন শফিকুল। পেছন থেকে আরেকটি বাস সজোরে ধাক্কা দিলে প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান শফিকুল।
উত্তরা সেন্ট্রাল হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, শফিকুলকে মৃত অবস্থায়ই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরে রাত আড়াইটায় সেখান থেকে সুরতহাল রিপোর্টের জন্য থানায় এবং এরপর ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
শফিকুলের সহকর্মী এসবির উপ-পরিদর্শক (এসআই) জয়নাল আবেদিন বাংলানিউজকে জানান, অসম্ভব ভালো আচরণের গুণ ছিল তার। সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতেন। শফিকুল পুলিশের একজন শীর্ষ ও ভালো কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
তার ছোট ভাই আজিজুল ইসলাম জানান, টঙ্গী কলেজ থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স শেষ করে এলএলবিও পাশ করেছিলেন শফিকুল । তার স্বপ্ন ছিল বড় পুলিশ অফিসার হওয়ার। সঙ্গে সঙ্গে আইন পেশায়ও নিজেকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।
‘অনেক স্বপ্ন ছিল আমার ভাইয়ের’- বলে কেঁদে ওঠেন মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে থাকা আমিরুলও।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৫
এইচএ/