ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

গেরিলা যোদ্ধা মকবুল-ই-ইলাহী

‘মুক্তিযুদ্ধের মতোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চাই’

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও ইসমাইল হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
‘মুক্তিযুদ্ধের মতোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চাই’ ছবি: জি এম মুজিবুর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে ক্যাম্পেইন করা হতো, একইভাবে বর্তমানেও ক্যাম্পেইন করে পাকিস্তানকে চাপে রাখা উচিত’।

কথাগুলো বলছিলেন একাত্তরের বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মকবুল ই-ইলাহী চৌধুরী (মশগুল চৌধুরী)।



বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও আমেরিকার অনেক জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তেমন মডেলে প্রচারণা হতে পারে। তাহলে পাকিস্তান বাড়াবাড়ি করার সাহস পাবে না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরবর্তী পাকিস্তানের ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে মশগুল চৌধুরী বলেন, ‘কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা উচিত। এখানে বাংলাদেশের সাংঘাতিকভাবে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে ক্যাম্পেইন করা হতো, একইভাবে বর্তমানেও ক্যাম্পেইন করে পাকিস্তানকে চাপে রাখতে হবে। ’

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিকে সরকারের অনেক ব্যর্থতার মাধ্যে বড় সাফল্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সরকার সাহসের সঙ্গে বিচার করেছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা আমরা কাছে বিশাল পাওয়া। সরকারের সাহসের তারিফ করতে হয়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি’।

আদর্শে অবিচল এক যোদ্ধা
রংপুরের পীরগঞ্জে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম মকবুল ই-ইলাহী চৌধুরীর। লেখাপড়া ও চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। একাত্তরে পরিবারের অগোচরে তাদের বিনা অনুমতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে বহু কষ্টে ভারতে পাড়ি জমান, নেন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। ঢাকায় কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর গ্রুপে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন গেরিলা যুদ্ধে।

মকবুল ই-ইলাহী চৌধুরী বাংলানিউজের কাছে তার মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও রণাঙ্গনের দিনগুলোর কথা তুলে ধরেছেন। কয়েক দফায় পাকিস্তানি সেনাদের সামনে পড়ে গিয়েছিলেন, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। আমেরিকা সপ্তম নৌ-বহর প্রেরণের ঘোষণা দিলে তার নেতৃত্বেই হামলা করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার তোপখানা রোডের আমেরিকান ইনফরমেশন সার্ভিসেস সেন্টার। উদ্দেশ্য ছিল, আমেরিকার ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো।

মুক্তিযুদ্ধের পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন মকবুল-ই-ইলাহী। সরকারি চাকরিতে থেকেও গোপনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়তো। তাতে তার ভেতরে প্রচণ্ড রকম রক্তক্ষরণ হতো। এক সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশা ফিকে হয়ে এসেছিলো তার কাছে।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাক্টশন কোম্পানির (বাপেক্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ পেট্রোবাংলার পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন মকবুল ই-ইলাহী চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা মশগুল চৌধুরী কোর্স কারিকুলামের অংশ হিসেবে সত্তরের অক্টোবরে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। খেওড়া লবণের খনিতে কাজ করার সময় স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তিনি।

তার দৃষ্টিগোচর হয়, লবণ দিয়ে রুটি খাওয়া এবং জমিদারি প্রথায় বন্দি মানুষের জীবনচিত্র। তখন কমিউনিস্টরা ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি তত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। মশগুল চৌধুরী উপলব্ধি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ ন্যাশনাল ডেমেক্রেসি সম্ভব নয়। তাই স্বাধীনতা ছাড়া আর পথ নেই। আর কাঙ্খিত স্বাধীনতার পথ খুব সোজা নয়।

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সফরকালে বুঝতে পারলাম, শিগগিরই প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে। টিকে থাকতে হলে আন্ডারগ্রাউন্ড স্ট্রাকচারে যেতে হবে। জিততে হলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি জরুরি। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের মিটিংয়ে সেই প্রস্তাব তুলেছিলাম। দু’জন ছাড়া সবাই এর বিরোধিতা করেন’।

‘কয়েক দিনের মাথায় অভিসার সিনেমা হল, নবাবপুর ও বায়তুল মোকাররমের পাশে বন্দুকের দোকান লুট হয়। গোপীবাগ থেকে আমার এক বন্ধু সেই অস্ত্র দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ওই প্রস্তাব ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতাদের জানাই। তারা নিষেধ করে দেন। এরপর সাভার থানার অস্ত্র লুট করার অফার আসে। আমরা গেলেই তারা সব অস্ত্র দিয়ে দেবেন। ওই প্রস্তাবও  নাকচ করে দেয় ছাত্র ইউনিয়ন’।

মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে স্টেডিয়ামে (বর্তমান ঢাবির খেলার মাঠ) তখন ছাত্র ইউনিয়ন ডামি রাইফেল নিয়ে মহড়া দিতেন।   তখন অন্য একটি গ্রুপ অস্ত্র নিয়ে মহড়া করতো, আগরতলা মামলার আসামী সুলতান উদ্দিনও ছিলেন সেই গ্রুপে। ২১ মার্চে বলাবলি হতো, ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। কিন্তু মশগুল চৌধুরী মনে করতেন, সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া উপায় নেই।

তিনি বলেন,  ‘রাতে দুই-চারটা ককটেলের শব্দ না শুনলে মনটা চাঙ্গা থাকতো না। মনে হতো, আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ককটেল প্রয়োজন, বানাবো, কিন্তু নিরাপদ জায়গা পাচ্ছিলাম না। ভয়ে ভয়ে আমার ডিপার্টমেন্টের (ভূ-তত্ত্ববিদ্যা) বিভাগীয় প্রধান ড. আব্দুল লতিফ স্যারকে জানাই’।

‘স্যার কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে আসো। তাকে অনুসরণ করতে থাকি। সোজা নিউমার্কেট গিয়ে কয়েকটি তালা কিনে আবার ফেরত আসেন। ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের ল্যাবরেটরিতে নতুন তালাগুলো লাগিয়ে আমাকে একসেট চাবি দিয়ে দেন। আমি ড. শাহাদত ও মকবুল মিলে ছোট-খাট অ্যামুনেশন ও ককটেল বানানোর কাজগুলো করছিলাম’।

‘সিপিবি এবং ছাত্র ইউনিয়ন থেকে চাপ আসতে থাকে আমার ওপর। তারা মনে করতো, আমি অনেক অস্ত্র সংগ্রহ করেছি। ২১ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্যান্টিনে ছাত্র ইউনিয়নের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে তৎকালীন সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদ (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) আমাকে চাপ দিয়ে বসেন, ‘তুমি অস্ত্র সংগ্রহ করে পার্টির ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছো। এগুলো স্যারেন্ডার করতে হবে। আমি অস্ত্র সংগ্রহ করিনি জানালেও মাত্র দু’জন ছাড়া অন্যরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইলেন না’।

‘পরদিন আমি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেই’।

২২ মার্চ রাত ৯টায় সুলতান উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক হয়। তাতেও সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রস্তাব তোলেন মশগুল চৌধুরী। সুলতান উদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা হয়ে যাচ্ছে। এখনই প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। আপাতত বাড়ি ঘুরে আসো। পরে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে’।

তিনি বলেন, ‘পরদিন রেল ধরে বাড়ি চলে যাই। ২৫ মার্চ রাতে ক্র্যাকডাউন হলো। রংপুরে পাখি বাবুকে মেরে ফেললো। ঢাকার খবর পাচ্ছিলাম না। পীরগঞ্জ থানা লুট হলো। সীমান্তেও কড়াকড়ি হচ্ছে। যাতে কেউ ভারতে যেতে না পারে। ’

‘যোগাযোগ করলাম মনি কৃষ্ণ সেনের সঙ্গে। তিনি আমাকে বলে গেলেন, আমি ভারত যাচ্ছি। খবর পাঠালে চলে এসো। সঙ্গে নিয়ে যান খোরশেদ লোহানীকে। কিন্তু দেশে ফেরার সময় খোরশেদ লোহানী পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হন। তারও কোন খবর পচ্ছিলাম না’।

‘এদিকে বাড়িতে আমার ওপর নজরদারি। বাবাকে বললাম অ্যালো মি টু গো। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি মিললো না। বিনা অনুমতিতে যেতে চাইলাম। কিন্তু ‍আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। বাধ্য হয়ে ভালো ছাত্রের ভোল ধরলাম। বললাম, ক্লাস শুরু হয়েছে ঢাকায় যাবো’।

মকবুল ই- এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘জুলাইয়ে ঢাকা চলে এলাম। ভার্সিটিতে দু’একটি বিভাগে ক্লাস হতো, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস হতো। ঢাকায় একটা পটকাবাজি হলেও মনে হতো মরে যাইনি’।

‘যুদ্ধে যাওয়ার উপায় খুঁজছিলাম। কবির ও মায়ার (মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া) গ্রুপ ছিল। মায়া বললেন, কবিরের লোকজন যাচ্ছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ওই গ্রুপের সঙ্গে ৫ জন জয়েন করলাম ভারত যাওয়ার জন্য। লতিফ স্যার শুনে ২০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন’।

‘ঢাকা থেকে ডেমরা ফেরিঘাট। বাসে যাবো, কিন্তু বাসে একজনের পকেট কেটে টাকা চুরির ঘটনায় ড্রাইভারকে নামিয়ে নিলো পাকিস্তানি সেনারা। ড্রাইভার প্রতিবাদ করলেন, যাবে না। আমাদের মধ্যেও প্রতিবাদের ঝড় উঠলো’।

‘সময়টা আগস্টের মাঝামাঝি। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে মেঘনা নদী পার হতে হবে। মাধবদী থেকে নৌকা নিয়ে যাবো। কিন্তু নৌকা পাচ্ছিলাম না। শেষ পর্যন্ত একটু বেশি টাকা দিয়ে নৌকা ম্যানেজ করলাম। দুলতে দুলতে নৌকায় নদী পার হয়ে চারগাছ’।

‘আমাদেরকে জানানো হলো, এখানে থাকা যাবে না, আর্মি রেইড দিচ্ছে। পাশের গ্রামে ফাইট করছে। সন্ধ্যার পর নৌকায় উঠলাম, সঙ্গে আরও ৪/৫ জন। ব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে হতো। রাজাকারের বেশে মুক্তিবাহিনী থাকতো ওপরে। একটি গুলি ছুঁড়লে ক্লিয়ার, দু’টি দিলে বিপদ’।

‘৫ দিন ধরে পারাপার বন্ধ থাকায় লম্বা লম্বা ধান ক্ষেতের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ পানিতে ভাসতে লাগলাম। এক সময় সিগন্যাল এলো। আমরা যেই ব্রিজের কাছাকাছি গেছি, হঠাৎ দুই রাউন্ড গুলির শব্দ। তড়িঘড়ি করে নৌকা পেছন দিকে সরে আসে। ব্রিজের ওপর থেকে পাকিস্তানি সেনারা বেশ কিছু সময় গুলি ছুঁড়লো। চলে যাওয়ায় পর ব্রিজের নিচ দিয়ে মাইনিয়ান নামক স্থানে স্কুলে উঠলাম’।

‘এরপর আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট হোটেলে গিয়ে রিপোর্ট করলাম, সেখানে লাইন দিয়ে খেতে হবে। আমাকে পরিচয় করিয়ে না দেওয়ায় খাবার দেওয়া হচ্ছিলো না। ট্রেনিংয়ে কবে যাবো তাও জানা নেই’।

তিনি বলেন, ‘খালেদ মোশাররফের বড় বোন (ডাকনাম হেনা) যাওয়ার সময় একটা চিরকুট লিখে দেন। তাতে লেখা ছিল,  ‘ভাই মনি (খালেদ মোশাররফের ডাক নাম) রুলির ছেলে মশগুলকে পাঠালাম, ওকে তোমার কারখানায় একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিও। আমরা সবাই ভালো আছি। তোমার শুভ কামনায়-হেনা’।

‘চিঠি দেখানোর পর সেখানে টংয়ে থাকতে দিলো। মাঝরাতে একজন ঘুমালেন। সকালে উঠে দেখলাম, তিনি হচ্ছেন মনন ভাই। পরদিন আমার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হলো। মেলাগড়ে অ্যামুনিশন রাখার কক্ষের পাশেই আরেকটি কক্ষে থাকতে দেওয়া হলো। ওখান থেকে বাগমারা ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হলো। সেখানে ২১ দিন ছিলাম’।

একাত্তরের রণাঙ্গনে
মকবুল-ই ইলাহী বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রবেশ করাটাই ছিলো আমার জন্য টাপেস্ট অপারেশন। কমান্ডার মেজর হায়দার নির্দেশ দিলেন, যেদিক থেকে গুলি আসবে সেদিকে জয় বাংলা বলে এগিয়ে যেতে হবে। পেছনে ফেরা যাবে না। ফিরলে ব্যুবে ট্রাপে পড়ে যাবো। এতে নিজেও মরবো, অন্যরাও মারা পড়বে’।  

‘এ কথার পর সামনে এগোতে ভয় করেনি আপনাদের?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেন যেন ভয়টা তখন ছিল না, কোথায় উঠে গিয়েছিল, জানি না’।

‘অক্টোবরের শুরুতে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ৫০টি এসএমজি, ২টি এলএমজি, ১০টি এসএলআর,  ৪টি গ্রেনেড ও প্রত্যেককে ২৫০টি করে গুলি ও অন্যান্য অ্যামুনেশন দেওয়া হলো। আমাদের ট্রাকে করে হাতিমারা এলাকায় (কুমিল্লা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে) নামিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের ৬৫ জনের লিডার ছিলেন মায়া ভাই। আরও একটি গ্রুপ আমাদের সঙ্গে দেশে প্রবেশ করে। সব মিলিয়ে ১১০ জন ছিলাম’।

গোমতি ব্রিজের ২৫০ গজ দূরে পাঁচটি গ্রুপ হয়ে রেল ‍লাইন পার হতে লাগলাম। দু’টি গ্রুপ পার হয়েছে প্রায় অর্ধেক ধপাস ধপাস করে পড়ে গেল। টের পেয়ে প্রায় ১৫ মিনিট পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালায়। তবে রাতে তারা বের হতো না। সকালে গোমতি নদীর পাড়ে একটি স্কুলে উঠলাম। প্রচণ্ড ক্ষিদের মধ্যে গ্রামের লোকজন বেগুনের চরচরি, ডাল-ভাত খেতে দিলেন। বেগুনের চরচরি এতো মজার হয়, সেদিন প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম’।

মশগুল চৌধুরী বলেন, ‘এরপর হাঁটা শুরু করলাম। মুরাদনগরের দিঘিরপাড়ে পৌঁছালাম। নৌকা নিয়ে বাতাকান্দি। শুনলাম, সেখানে কাশেম ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। একজন খবর দিলেন পাক বাহিনী আমাদের খবর জেনে গেছে। আমরা যেনো দ্রুত ‍বাতাকান্দি ত্যাগ করি। আমরা রাতেই নৌকায় করে বৈদ্যেরবাজার পৌঁছালাম। সকালেই বাতাকান্দি অ্যাটাক করলো’।

 ‘ওই দিন রক্ত আমাশয় এবং প্রচণ্ড জ্বর শুরু হলো। সেখান থেকে জামতলীতে দু’দিন ছিলাম। এরপর নদীর পাড়ে এক হিন্দু বাড়িতে উঠলাম। ওখানে আমার জন্যে প্রচুর পরিমাণে ওষুধ এলো। আমি ওষুধের নাম, রোগের নাম খাতায় টুকে রাখলাম। যাতে পরবর্তীতে কাজে লাগে। ২০ দিন পর বালু ও শীতলক্ষ্মা নদীর মাঝামাঝি স্থানে এলাম। ঢাকার কাছের ক্যাম্প ছিল মানিকনগরের বাইকদায়’।

‘লোকজন জিজ্ঞেস করতেন, দেশটা কবে স্বাধীন হবে? রণাঙ্গন পত্রিকায় ক্যাপ্টেন আব্দুল আলীম চৌধুরীর লেখায় সেই উত্তর ছিল- যেদিন অস্ত্র হাতে নেবেন, সেদিনই দেশ স্বাধীন হবে। আমি সেই পত্রিকা নিয়ে আসছিলাম ঢাকায়’।

‘রোজার ঈদের সময় ইছাকুড়া বাজারে মুক্তিযোদ্ধারা দু’জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। পাকিস্তানি সেনারাও পেছন দিক থেকে মুরাপাড়া দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে বকুল নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে তিনি একটি গুলি করলেন। সেই গুলিতে আমরা সাবধান! দু’জন পাকিস্তানি সেনা কবরস্থানে আশ্রয় নেয়। গ্রামবাসী তাদের হত্যা করেন’।

মশগুল চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে চলেন, ‘ডিসেম্বরে দায়িত্ব পড়লো একই দিনে দু’টি অপারেশন চালানোর। একটি অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি), অপরটি হচ্ছে আমেরিকান ইনফরমেশন সার্ভিসেস (ইউএসআইএস)। মানিকনগর থেকে ব্রিফকেসে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ নিয়ে ঢাকায় ঢুকলাম। ঢোকার সময় আজিজ সহযোগিতা করলেন, অত্যন্ত সাহসী ছেলে। আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে বাইপাস করে ঢাকায় ঢুকলাম। পাকিস্তান সেনারা সন্দেহ করেনি আমাদের’।

‘সচিবালয়ের পাশের এমন একটি স্থানে হতাহত কম রাখতে সবরকম পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আহসান উল্লাহ হলের ক্যান্টিনে আনা হলো দু’টি ব্রিফকেস। সেখান থেকে মোস্তফা আমিন বাবুল ব্যাগ নিয়ে গেলেন এপিপি’র জ্বালানোর জন্য’।

‘আরেকটি ব্যাগ নিয়ে রওনা হবো। ঠিক তখন স্থপতি মোবাশ্বের আমার হাত ধরে বসেন। মশগুল এতো সহজ অপারেশন আর পাবো না। আমি এই অপারেশনে অংশ নিতে চাই। পরে জিয়া গাড়ি চালালেন। সম্ভবত সময়টা ছিল ১০/ ১০/ ১০। অর্থাৎ ১০ তারিখ ১০টা ১০ মিনিট’।

‘১৪ ডিসেম্বর আমরা ঢাকায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন আমাদের ক্যাম্পে এলেন মেজর হায়দার। তিনি বললেন, দুই-তিন দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। এই মুহূর্তে যেন একটা জীবন নষ্ট না হয়। কুমিল্লায় লুটপাট হয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে, ঢাকায় যেনো কোনো লুটপাট না হয়’।

‘আমরা ১৬ ডিসেম্বর বালু নদীর পাড়ে জড়ো হলাম। বিকেল ৩টার সময় হেলিকপ্টার আসা শুরু করলো। আমরাও পেছন পেছন দৌড়ালাম। মুগদা দিয়ে প্রবেশ করলাম। সবাই জড়িয়ে ধরেন আর বলেন, রাজাকার ইদ্রিসকে (নারিন্দার) মারতে হবে। ও অনেক নির্যাতন করেছে’।

‘ওই রাতেই তার বাসায় দিকে এগিয়ে গেলে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। মায়া বললেন, দিনের বেলা দেখা যাবে। রাতে আদেশ হলো ফরাশগঞ্জ যাও। গিয়ে দেখি, ফরাশগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, কোনো অস্ত্র যাবে না। ওসি বললেন, আমি কী করবো? বললাম, এতোদিন পাকিস্তানের হয়ে কাজ করছেন। এখন বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে হবে’।

‘পরদিন ইদ্রিসকে স্যারেন্ডার করতে বললে আবার গুলি করে। এতে আমাদের ৩ জন আহত হন। আমরাও পাল্টা গুলি করলে সে নিহত হয়’।  

বিজয়ের দিনে
মকবুল-ই-ইলাহী বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর নবাবপুর রোডে লুটপাটের খবর শুনে সেখানে যাই। ফাঁকা গুলি করে লুটপাট ঠেকাই আমরা। বিজয়ের সেই দিনের রিসিপশন ভোলার মতো নয়। একজন তরুণী মেয়ে কীভাবে যুবককে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানান। সেই সময় এই ধরনের কালচার ছিলো না’।  

তিনি বলেন, ‘পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে। বাংলাদেশে আসার পর থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা হয়নি। ইয়্যুথ ক্যাম্পে(ট্রেনিংয়ের জন্য অপেক্ষমান ক্যাম্প) থাকতে হয়নি, যেখানে ডালের উপর পোকা ভাসতো, সেই পোকা সরিয়ে ভাত খেতে হতো’।

বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
ইএস/এমআইএইচ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।