ঢাকা, রবিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

আতংকের জনপদ থেকে উন্নয়নের ধারায় বড়াইবাড়ী

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৭
আতংকের জনপদ থেকে উন্নয়নের ধারায় বড়াইবাড়ী উন্নয়নের ধারায় বড়াইবাড়ী। ছবি-বাংলানিউজ

বড়াইবাড়ী সীমান্ত, রৌমারী থেকে ফিরে: বাড়ির উঠানে বসে মাছ কাটছেন নূরেজা খাতুন। পাশে বসে তাকে সহযোগিতা করছেন শাশুড়ি। স্বামী আবুল হোসেন বাড়ির পার্শ্ববর্তী সীমান্ত ঘেঁষা ধরণী নদী থেকে ধরে এনেছেন ছোট ছোট দেশি মাছ।

তাদের চোখে-মুখে নিশ্চিন্ত ও নির্বিঘ্ন জীবনের আনন্দের ঝিলিক। দীর্ঘদিনের ভীতিময় ও বঞ্চনার জীবন এখন মুক্তির আলোক ছটায় যেন চক চক করছে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এই জনপদের মানুষগুলোর মুখাবয়বে।

শুধু নূরেজা বা আবুল হোসেনেরই নয় ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষা বাংলাদেশের রৌমারী উপজেলার সীমান্তবর্তী পুরো বড়াইবাড়ী গ্রামের মানুষের চেহারায় এখন উৎফুল্লতা আর আনন্দের আলোকছটা।
বাড়ির উঠানে বসে মাছ কাটায় ব্যস্ত দুই নারী
মাত্র দুই বছর আগেও এখানকার অধিবাসীদের দিন কাটতো উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। রাত নামলেই আঁধারে নিমজ্জিত জনপদে তৈরি হতো এক ভীতিকর পরিবেশ। শুরু হতো ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র পদচারণা আর হুমকি-ধামকি।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা বড়াইবাড়ী গ্রামের বিরোধপূর্ণ ২২৬ একর অপদখলীয় জমির এসব অধিবাসীদের কোনো উন্নয়ন হয়নি। এই জমিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকবার যুদ্ধও হয় দু’দেশের মধ্যে।

অবশেষে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের সময় সুরাহা হয় বিরোধের। অপদখলীয় বড়াইবাড়ী বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ায় নতুন করে সীমানা নির্ধারণ করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। অপদখল মুক্ত হয় ঐতিহাসিক বড়াইবাড়ীর ২২৬ একর জমি। সেই সাথে প্রাণ ফিরে পায় এখানকার ৬ শতাধিক অধিবাসী।

কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দীর্ঘদিনের অবহেলিত উন্নয়ন বঞ্চিত সীমান্তবর্তী জনপদ ঐতিহাসিক বড়াইবাড়ী গ্রামে ৬৭ বছর পর লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। মাত্র দুই বছর আগেও যে গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই ডুবে যেতো নিকশ আঁধারে, জ্বলতো না কোনো আলো। এখন সেখানে ঘরে ঘরে পৌঁছেছে বিদ্যুতের সংযোগ। বিদ্যুতের আলোয় অনেক রাত পর্যন্ত চলছে অধিবাসীদের নির্বিঘ্ন চলাফেরা। বিদ্যুতের আলোয় প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারছেন গ্রামের মানুষ, স্কুলের শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করছে।
বড়াইবাড়ী গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া।  আনন্দের সাথে স্কুলে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
বড়াইবাড়ী গ্রামের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সীমা ও রঞ্জনা বাংলানিউজকে বলে, আমরা রৌমারীর কলাবাড়ী বিবিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। আগে ভয়ে ভয়ে থাকতে হইতো, স্কুলে যাইতে পারি নাই। এখন আনন্দের সাথে স্কুলে যাইতে পারি, মন খুলে কথা বলতে পারি, খেলতে পারি।

বড়াইবাড়ীর গ্রামের গৃহবধূ রাবিয়া খাতুন (৪০), জমিলা বেগম (৪৫) বাংলানিউজকে বলেন, বাড়ির পিছনেই ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়া। আগে আতংকের মইধ্যে দিন কাটতো। রাইতের বেলা গুটিশুটি হইয়া মরার মতো পইড়া থাকতে হইতো। অহন বাংলাদ্যাশ হইছে, বিদ্যুতের আলো আইছে। অহন রাইতের বেলাও আর ডর লাগে না।

বড়াইবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন (৬০), নুরুল ইসলাম (৪৫), সাখোয়াত হোসেন লিপন (৩৫) বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ ৬৭ বছরের বঞ্চনার পর শুরু হয়েছে উন্নয়ন। শুরু হওয়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণসহ ভাগ্যের যেমন উন্নয়ন ঘটবে, তেমনি বড়াইবাড়ী গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ-কষ্ট লাগব হবে।
আতংকের জনপদ থেকে উন্নয়নের ধারায় বড়াইবাড়ী
কুড়িগ্রাম-৪ আসনের স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. রুহুল আমীন বাংলানিউজকে বলেন, ভারতের অপদখলীয় বিরোধপূর্ণ ঐতিহাসিক বড়াইবাড়ী গ্রামটিসহ আশেপাশের এলাকা দীর্ঘদিন উন্নয়ন বঞ্চিত ছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিরোধপূর্ণ বড়াইবাড়ী সমস্যার সমাধান হওয়ায় বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও সাফল্যের অংশ হিসাবে প্রাথমিকভাবে ২২ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে দুই বছরের মাথায় সীমান্তবর্তী পাঁচ গ্রামের ৬শ’ ৪৯ জন মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে শুরু হয়েছে কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১১.৭৫ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের আলো। চলছে দুই কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ধরণী নদীর উপর ৬৬ মিটার ব্রিজ নির্মাণের কাজ। এক কোটি টাকা ব্যয়ে বড়াইবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ ছাড়াও কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণ।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৭
এফইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।