ঢাকা, রবিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

মংডুতে নিপীড়ন দেখেছি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৭
মংডুতে নিপীড়ন দেখেছি মংডুতে সেনা নির্যাতন।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন ও দেশছাড়া করার কারণে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে সমালোচিত দেশ মিয়ানমার বা সাবেক বার্মার মংডু শহরে ২০১৫ সালে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখনই সেখানে দেখেছি নিপীড়নের বহু দৃশ্য। বর্তমান জাতিগত অত্যাচার দেখে সেদিনের প্রত্যক্ষ স্মৃতি মনে পড়ছে।

পর্যটন নগরী কক্সবাজারের উপজেলা রামুতে তিন বছরেরও বেশি কর্মসূত্রে থাকার সময় সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেসব জায়গা এখন লাখ লাখ উদ্বাস্তু নর-নারীর আহাজারিতে বিপণ্ন।

সীমান্তবর্তী লেমুছড়ি, তুমব্রু, ঘুমধুম, চাকঢালা, আশারতলী  প্রভৃতি বিওপি পয়েন্টে যাওয়ার সুযোগে মিয়ানমার ভ্রমণেরও সুযোগ এসে যায় আকস্মিকভাবে। তদুপরি কয়েকবার মিয়ানমার সীমান্তে যাওয়ার কারণে ওপারে যেতে উৎসুক ও কৌতূহলী ছিলাম। হঠাৎ সুযোগ এসে গেল। কয়েকজন সহকর্মীসহ দেখতে গেলাম মিয়ানমার।


ভ্রমণের দিন ঠিক হল ৪ জানুয়ারি রোববার। মিলাদুন্নবী ( দ:) উপলক্ষে অফিস তখন বন্ধ। পৌষ মাসের কুয়াশাস্নাত ভোরে রামু হতে রওয়ানা দিয়ে টেকনাফ লিংক রোড ধরে নিজস্ব গাড়িতে আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ বেয়ে উখিয়া, হ্নীলা হয়ে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে  টেকনাফ স্থল বন্দরে পৌঁছুলাম। এখানে এসে বর্ডার পাস বুঝে নিলাম।

হালকা নাস্তা ও  ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে ট্রলারে ওঠার অপেক্ষা। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সোজা-সাপটা জানিয়ে দিলো, কেবল নগদ ৫০০০ টাকা (১ টাকাও বেশি না)  ছাড়া কোন মোবাইল, ক্যামেরা, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য, মানিব্যাগ এমনকি কোনো কাগজপত্রও নেয়া যাবে না।   মনে মনে ভাবলাম এ না হলেই কি মগের মুল্লুক!!

সত্যিই মগের মুল্লুক!!  অগত্যা ড্রাইভারের কাছে মানিব্যাগ, মোবাইল, ক্যামেরা, ব্যাগ জমা রাখলাম। আর বিকাল ৫টায় টেকনাফ স্থল বন্দরে আমাদের ফিরে আসা পর্যন্ত থাকতে বললাম।

মংডুতে পুড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা গ্রাম।  মোবাইল না থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নভাবে চলেছি। পকেটে ৫০০০ টাকা ছাড়া কিছুই নেই। ক্যামেরা, মোবাইল না নিতে পারায় মনটা খারাপ হয়ে আছে। স্মৃতিস্বরূপ কোন ছবিই থাকবে না!  এ আধুনিক একবিংশ শতাব্দীর যুগে এমন জংলী আইন! ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল।

ট্রলারে উঠে মনে হলো অজানায় চলেছি। কাঠের ট্রলার, মাছ ধরার ট্রলারই বলা চলে, খোলা, ছাদ নেই। কাঠের  তক্তার উপর বসার জায়গা। অনেক যাত্রী নিয়ে সকাল সাড়ে ন’টায় ট্রলার ছাড়ল। একটু দূরে সেন্টমার্টিনে গমনকারী কেয়ারি সিন্দবাদ, গ্রীনলাইন ক্রুজার দেখা যাচ্ছে।

নিজেকে মিসকিন মিসকিন মনে হল, কাঠের ট্রলারে বিদেশ ভ্রমণ!!  এর আগে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কখনোই এতো আন-ইজি লাগেনি।  

ট্রলার চলতে শুরু করলো শান্ত, শীতল নাফ নদী বেয়ে। সেন্টমার্টিনের পথে কিছুদূর এগিয়ে বামে মোড় নিল।

ডানে টেকনাফের সুউচ্চ পাহাড়, মাতৃভুমি বাংলাদেশের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, মনটা আনচান করে উঠল।

খোলা ট্রলারে প্রখর রোদ, অনেক রোহিঙ্গা, মিয়ানমারের নাগরিক নারী-শিশু-পুরুষ, যারা পাস নিয়ে বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশে এসে ফেরত যাচ্ছে। কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। ওরা ওদের জীবনমান, অধিকার, বঞ্চনা নিয়ে দুঃখের কথা জানালো। চেহারা ও স্বাস্থ্য দেখেও তাদের অবহেলিত অবস্থা বোঝা গেল। আড় চোখে দেখলাম আমরা দু-চারজন ছাড়া সব পুরুষরাই লুঙ্গী পরিহিত। কয়েকজন নারী বোরকা পরেও ছাতা মাথায় দিয়ে পর্দা করছেন।

জন্মভূমি ছেড়ে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা।  প্রখর রোদ, আমি আর সফরসঙ্গী সালেক সাহেব আবার কোট, প্যান্ট, শু পরিহিত। হাজার হলেও বিদেশ ভ্রমণ বলে কথা!!  সেজে-গুজে তৈরি হয়ে এসে এখন  নিজেদের বেমানান লাগছে। গরম তো লাগছেই। ভাগ্যিস টাই পরিনি। পরলে কী অবস্থা হতো!!  

আমরা সোয়া এক ঘণ্টা পর মংডু শহরের বন্দরে পৌঁছুলাম। এ সেই মগের মুল্লুক!!  আজব দেশ!!  রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত মংডু শহর। হাজার হাজার  নির্যাতিত নারী -পুরুষ- শিশুর আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী করা শহর।

মংডু বন্দরের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেলো, পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির পুকুরে শান বাঁধানো পাকা ঘাটের মতো একটা  ঘাট। উপরে টিনের ছাউনি। বৈঠকখানার মতো দুপাশে বসার ব্যবস্থা। সেখানে ট্রলার থেকে ওঠা-নামার ব্যবস্থা।

আমরা নেমে ঘাটে দাঁড়ালাম। দেখলাম লুঙ্গি, গেঞ্জি ও স্যান্ডেল পরা অস্ত্রধারী সীমান্তরক্ষী। গেঞ্জি আবার লুঙ্গির ভেতরে ‘ইন করা’!!  

জীবনে অনেক ক্যাডার ও অস্ত্রধারী দেখেছি, কিন্তু এ রকম ক্যাডার তো দেখিনি। তবে কয়েকজন ইউনিফর্মধারীও আছে।

আমাদের সবাইকে কাস্টমস শেষে ইমিগ্রেশন রুমে নেয়া হল। ছবি তুলবে সবার। বর্ডার পাসে সিল-ছাপ্পর মেরে ছবি তোলার জন্য সবাইকে এক রুমে জড়ো করা হল। সবাইকে কঠিন নিদের্শ নিয়ে নীরবে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। আমরাও ঠেলে লাইনে দাঁড়ালাম।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গাদের পলায়ন।  শুধু ছবি তোলা নয়। যাচাই-বাছাইও চললো। কারণ একেক জনের ছবি তুলতে  ১০/১৫ মিনিট টাইম নিল। রেডি বলে সাটার টিপে, কিন্তু  ক্যামেরা অন হয় না। ছবি তুলতে অনেক কাহিনী করল।   ইংরেজিতে তেমন কথা বলতে পারে না, খালি ‘অং পং মং চং’ এসব বুলি আওড়াচ্ছে।

বাইরে এসে দেখি, কয়েকজন রোহিঙ্গা ছেলে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে রীতিমত ঝগড়া লেগে গেল তাদের মধ্যে, কার রিকশায় ওঠাবে তা নিয়ে। চাটগাঁইয়া ভাষায় তারা বলছে, ‘আঁর রিকশাত উডন অনেরা, আঁর রিকশাত, আঁর রিকশাত’। দুটো পয়সা কামানোর জন্য হত-দরিদ্র রোহিঙ্গাদের কি প্রাণান্তকর চেষ্টা!  রিকশাগুলো আবার আমাদের দেশের মতো নয়। অনেকটা রুগীদের হুইল চেয়ারের মত। তবে দুপাশে দুজন বসতে পারে, একজনের পিঠের সাথে অন্যজনের পিঠ লাগিয়ে দুজন দুদিকে মুখ করে বসতে হয়। চাইলেই হাত দিয়ে মাটি স্পর্শ করা যায়। চালক সামনে, আমাদের দেশের রিকশার মত সামনের সিটে বসে চালায়।  

আমরা একটি রিকশা ভাড়া করে চালক রোহিঙ্গা ছেলের সাথে গল্প করতে করতে এক বাজারে এলাম টাকা এক্সচেঞ্জ করার জন্য। বাংলাদেশি ১ টাকা সমান মিয়ানমারের ১৩ কিয়াত। আমাদের নেয়া ৫০০০ টাকায় মোট ৬৫০০০ কিয়াত পেয়ে শার্ট প্যান্টের সব পকেট ভর্তি হয়ে গেল। খুশিতে মনটা নেচে উঠল। কিন্তু সে খুশি একটু পরেই উবে গেল।

আমরা যে মংডুতে এসেছি, তা মিয়ানমারের একটি জেলা শহর। যা আমাদের টেকনাফ সীমান্তের ঠিক ওপারেই অবস্থিত। নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন (পুর্বের নাম আরাকান) রাজ্যের ১৭টি শহরের মধ্যে একটি জেলা শহরের নাম মংডু। পাঁচ লক্ষাধিক জনসংখ্যার মধ্যে ৭৫ শতাংশ মুসলিম, বাকিরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী  মগ জাতির মানুষ। মংডু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি না হলেও শাল-সেগুন-চন্দন গাছের অত্যন্ত সুন্দর বাগান ঘেরা শহর, অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। যদিও মিয়ানমারের সামরিক সরকার পর্যটকদের তেমনভাবে মিয়ানমার ভ্রমণ করতে দেওয়ার আগ্রহ দেখায় না। তবে লক্ষ্য করেছি, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানায় জান্তা সরকার।

মংডু ভ্রমণের জন্য এক ধরনের বিশেষ ভিসা (পাস) প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মংডু ভ্রমণের জন্য একটা পাস বই নিতে হবে। যাতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার ইমেগ্রেশন কর্মকর্তাদের অনুমোদন এবং স্বাক্ষর রয়েছে।

বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৩ দিনের এনট্রি পাস (শুধু মংডু শহরের জন্য) নেবার পর কাস্টমস কর্মকর্তা এবং বিজিবি’র  তল্লাশী শেষে ট্রলারে মংডু পৌঁছুবেন। মংডু পৌঁছুতে জোয়ারের সময় খরস্রোতা নাফ নদী পার হতে সময় লাগবে পৌনে এক ঘণ্টা। ভাটার সময় দেড় ঘণ্টার মতো।

মংডু অত্যাধুনিক শহর নয়। অনেকটা আমাদের বরিশাল কিংবা ময়মনসিংহ’র মতো অনেক পুরনো শহর। নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে অনেক কিছু জানার জন্য এই শহরের ঐতিহ্য রয়েছে।

মংডুর লোকেরা তান্ত্রিকতায় খুব বিশ্বাসী। এরা এখনো মুর্মূর্ষু অবস্থা না হলে ডাক্তারের কাছে সহজে যায় না। এরা ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজে বিশ্বাসী। এখানকার বাড়ি-ঘরগুলো সব সেগুন কাঠের তৈরি-দোচালা। তিন চালা টিনের ঘরগুলো দেখতে অনেকটাই ক্যাং ঘরের (বৌদ্ধদের উপাসনালয়) মতো। কোনটা যে ক্যাং ঘর আর কোনটা মানুষের বসত বাড়ি তা দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।

বিশাল আকৃতির প্যাগোডা আছে ১২টি। আছে অসংখ্য ভাঙ্গাচোরা মাদ্রাসা-মসজিদ। সরকার এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা সংস্কার করতে দেয় না। বরং সুযোগ পেলেই ভেঙ্গে দেয়। চারিদিকে শুধু বিশাল বিশাল শাল-সেগুন আর চন্দন গাছের বাগান।

মংডুবাসীরা রাখাইন এবং আদি চাটগাঁইয়া ভাষায় এবং কিছু কিছু উর্দু ভাষায় কথা বলে। এখানে চা'র দোকানকে বলে ইয়ং নী, ভাতের হোটেলকে বলে বাতং নী। মুসলমানদের হোটেলে ভাত, ভর্তা, মাছ, মাংস সবই পাওয়া যায়। তবে এরা সবাই শুটকি খেতে অভ্যস্ত। মগরা স্থানীয়ভাবে তৈরি মদ পানে অভ্যস্ত।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ছে রোহিঙ্গারা।  জেলা শহরে উল্লেখ যোগ্য সরকারি অফিসের মধ্যে আছে মিয়ানমার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জেলা অফিস, বর্ডার চেম্বার অব কমার্স অফিস এবং মিয়ানমার ইমিগ্রেশন এন্ড পপুলেশন ডিপার্টমেন্ট অফিস। মংডু মূলত সেগুন এবং অন্যান্য উন্নতমানের কাঠের বিশাল মার্কেট। বাংলাদেশি কাঠ ব্যবসায়ীরা এখান থেকেই কাঠ এবং মাছ আমদানি করে থাকে। মিয়ানমার রত্ন পাথরের জন্যও প্রসিদ্ধ।

মংডুতে প্রবেশের পুর্বে নাসাকা বাহিনী এবং মংডুর ইমিগ্রেশন বিভাগে লিখিত অঙ্গীকারনামা দিয়ে ঢুকতে হবে যে, আপনার সাথে কোন ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্য বিশেষ করে সেল ফোন এবং ক্যামেরা নেই। ওখানে বিদেশিদের জন্য এসব জিনিষ বহন নিষিদ্ধ। মংডু থেকে আপনার পারমিশান থাকলে আকিয়াব যেতে পারবেন। আকিয়াব যাবার কারণ হতে হবে অবশ্যই ব্যবসায়িক। সাথে থাকতে হবে ট্রেড লাইসেন্স, চেম্বার অব কমার্সের মেম্বারশিপ, ইমপোর্ট লাইসেন্স। আকিয়াব যেতে জাহাজে সময় লাগে ১২ ঘন্টা। যাদের মিয়ানমার যাওয়ার ভিসা আছে, তারা জাহাজে করেই ইয়াংগুন যেতে পারবেন, সময় লাগবে ৪ দিন।

আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশ বই ফি (সোনালী ব্যাংকে চালানের মাধ্যমে জমা দেয়া) ৫০০ টাকা। ভ্রমণ কর ৫০০ টাকা। বন্দর শুল্ক ৫০ টাকা। ট্রলার ভাড়া ১০০ করে ২০০ টাকা (আসা যাওয়া)। মংডুতে প্রতিদিন থাকা খাওয়া সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা। ওখানে থাকার জন্য আছে-কেন্নাহ, সুওই, ওহো ইত্যাদি রেস্ট হাউজ।

বাজারে টাকা ভাঙানোর পর পকেট ভর্তি ৬৫ হাজার কিয়াত নিয়ে রিকশায় পুরো শহর ঘুরলাম। ছোট্ট পুরনো শহর। কিছু দোকান পাট, দোতলা কিছু পুরনো আমলের মার্কেট। পরিপাটি বহুতল মার্কেট তেমন চোখে পড়েনি। অধিকাংশ ঘরবাড়ি ছনের ও কাঠের, কিছু কিছু টিনশেড। তবে কিছু বাড়ি সুরম্য অট্টালিকা। পুরো শহরটা পুরনো আমলের, আধুনিক নগরের কোন ছাপ লক্ষ্য করলাম না। গাড়ি ঘোড়া বলতে অধিকাংশ রিকশা, কিছু ট্যাক্সি আর ২/১ টা কার এবং বাস চোখে পড়ল।

চলতে চলতে রিকশা চালক শহরের এক প্রান্তে এসে থেমে গেল, বলল এর পরে আর যাওয়া যাবে না। বুঝা গেল রোহিঙ্গাদের চলাফেরার স্বাধীনতা নেই। নির্দিষ্ট এরিয়ার বাইরে ওরা যেতে পারে না। নিজ দেশে এরা বন্দি, মনে হল পুরো মংডু শহরটা যেন একটা কারাগার।

শহরের এক প্রান্ত থেকে আসার পথে রিকশাচালক আধুনিক কয়েকটা বিল্ডিং দেখাল, যেগুলো নাকি মুসলমানদের, কিন্তু রাখাইনরা তাড়িয়ে দিয়ে দখল করে ফেলেছে। দুপুর গাড়িয়ে গেলেও কোথাও কোন আজানের ধ্বনি শুনলাম না। মুসলিম সংখ্যাগরিস্ট এলাকা হলেও আজান বা নামাজের আয়োজন করা প্রায়-অসম্ভব। অনেক খুঁজে কয়েকটা মসজিদ দেখলাম, পরিত্যক্ত ও তালাবন্ধ।

দুপুরের শেষ দিকে খাওয়ার জন্য একটি মুসলিম হোটেল খুঁজে নিলাম। মালিক চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছেন। দাম জেনে নিলাম কোয়েল ৩৫০০, মুরগী ২৫০০ কিয়াত। মুরগী, কোয়েল, সাদা ভাত, ডাল, সবজী খেলাম ৪ জনে। বের হয়ে চা, কফি খেলাম। পকেট ভর্তি ৬৫০০০/ কিয়াতের বিশাল বোঝা দ্রুত হালকা হতে লাগল। রিকশা ভ্রমণ বাবদ বিল এলো ৩৫০০ কিয়াত।

দ্রুত সময় ও টাকা ফুরিয়ে আসছে, তড়িঘড়ি করে একটা মার্কেটে গেলাম। মার্কেটটা অনেকটা চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দীন বাজার বা ঢাকার ফুলবাড়িয়া হকার্স মার্কেট স্টাইলের। কিছু কাপড়, আচার, চকলেট নিলাম। একটা জ্যাকেট নিলাম ১০ হাজার কিয়াতে।   সব কিয়াত প্রায় শেষ হওয়ার পথে।

আমাদের একদিনের ভ্রমণেরও সময় ফুরিয়ে আসছে। দ্রুত ইমিগ্রেশনের জন্য বন্দর ঘাটে এলাম। সব আনুষঙ্গিক কাজ সেরে বোটে উঠলাম। শীতের বিকাল, ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এবার আমাদের কোট কাজে লাগলো। চট্টগ্রামে একটা কথা আছে, '‘বাঁহা ( ফ্যাশন দূরস্ত লোক) শীতে মরে’ কথাটা মনে পড়ে গেল। বোট নাফ নদী বেয়ে এগিয়ে চলছে। পেছনে ফেলে এলাম শত শত বছর ধরে বসবাসরত ভাগ্য বিড়ম্বিত, অধিকার বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা জাতি অধ্যুষিত শহর মংডু। কত সহস্র নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মা-বোন, নারী, শিশু-পুরুষের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী করা শহর।

এই সেই নাফ নদী, যার নদীর স্রোতে মিশে আছে সহস্র রোহিঙ্গার রক্ত। ভিটেবাড়ি হতে উচ্ছেদ হয়ে জীবন বাঁচাতে গিয়ে এই নাফ নদীতে কতো সহস্র নারী-শিশুর সলিল সমাধি হয়েছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই।

এসব চিন্তা করতে করতে কখন টেকনাফ বন্দরে পৌঁছুলাম টেরই পাইনি। গোধূলি লগ্নে নিজ মাতৃভূমির মাটিতে নেমেই বুঝলাম, নাফ নদীর এপার ওপার কতো যোজন-যোজন দূরত্ব। মানুষের জীবনের অর্থ যেন আকাশ আর পাতালের পার্থক্য নিয়ে অবস্থান করছে নাফ নদীর দুই পাড়ে।

আবদুল আজিম: লেখক-ব্যাংকার, চট্টগ্রাম।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।