ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ফোরলেনের বিষফোঁড়া ‘মোড়-ওভারলোড’

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮
ফোরলেনের বিষফোঁড়া ‘মোড়-ওভারলোড’ ওভারলোডিংয়ের কারণে ফোরলেনে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ (ফাইল ছবি)

ঢাকা: যানবাহনের জটলা থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে নির্মিত হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোরলেন। কিন্তু কুমিল্লার দাউদকান্দির গোমতী সেতু, মুন্সীগঞ্জের মেঘনা ও নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর সেতু অংশে সব সময় জটলা লেগেই থাকে। ফলে স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত এই ফোরলেন সড়ক।

অনেক সময় কুমিল্লা থেকে ঢাকার ২ ঘণ্টার যাতায়াতে সময় যাচ্ছে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা। ফোরলেনের মোড়ে ইন্টারচেঞ্জ (মূল সড়ক থেকে পার্শ্ববর্তী সড়কে যাওয়ার জন্য র‌্যাম্প) না থাকায় এমন হচ্ছে বলে জানান সড়ক বিশেষজ্ঞরা।

ইন্টারচেঞ্জ না থাকায় মোড়ের জটলা সড়কে ছড়িয়ে পড়ছে।

একই অবস্থা ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোরলেনের। গাজীপুর চৌরাস্তা মোড়ে সব সময় জটলা লেগে থাকায় এই অবস্থা কয়েক কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে ওভারলোডের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোরলেনের অনেক স্থানে বেহালদশাও দেখা দিয়েছে।
 
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফোরলেনের সুবিধা পেতে হলে আগে ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করতে হবে মোড়ে মোড়ে। এটা নির্মাণে প্রত্যেক ফোরলেনের মোড়ে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ফোরলেনে উড়ালসড়ক অথবা ফ্লাইওভার জটলা থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। ফোরলেনের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করে যানবাহনগুলো সব রুটে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য ফোরলেন নির্মাণের মতো ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণেও আলাদা প্রকল্প নিতে হবে।
 
বাংলাদেশের অন্যতম সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি রাজধানী ঢাকায় কুড়িল ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করেছেন। অনেকের কাছে এটা ফ্লাইওভার নামে পরিচিত। তবে আসলে এটা ইন্টারচেঞ্জ।
 
শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দেখছি ফোরলেনেও জটলা।  এটা নিরসন করতে হলে ফোরলেনের মোড়ে ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করতে হবে। মোড় উন্নয়ন ছাড়া জটলামুক্ত ফোরলেন নির্মাণ সম্ভব নয়। যেমন কুড়িল ইন্টারচেঞ্জে কোনো জটলা লাগে না। কুড়িলের মতো ইন্টারচেঞ্জ ফোরলেনের মোড়ে নির্মাণ করতে হবে। কুড়িল ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণে ৪৬ একর জমি লেগেছে। তাই এখনই ফোরলেনের মোড়ে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে হাটিকমুরুল ফোরলেনের চন্দ্রা মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। আমি বলতে পারি, এখানের জটলা নিরসন হবে না। জটলা নিরসন করতে দরকার ইন্টারচেঞ্জ। এখনই সরকারকে আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে। আমরা ‘সিগন্যাল ফ্রি’ ভাবে চলতে চাই। একমাত্র ইন্টারচেঞ্জই আমাদের ‘সিগন্যাল ফ্রি’ সড়কের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
 
ফোরলেনে ক্ষত সৃষ্টি প্রসঙ্গে সড়ক বিশেষজ্ঞ বলেন, ১০ টনের জায়গায় ২২ টনের ট্রাক ফোরলেনে চলছে। এটা ঠেকাতেই হবে। এরপরে সড়কে প্রথমে ক্ষত হয় এরপরেই ক্ষতের জায়গা বাড়তে থাকে।
 
 
ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ও এশীয় মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্তির জন্য দেশের আরও ১৬টি মহাসড়ক ফোরলেনে রূপ দেওয়া হবে। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য এক হাজার ৭৫৬ কিলোমিটার। দীর্ঘ মহাসড়কের এই অংশ সিলেটের তামাবিল, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা এবং যশোরের বেনাপোল সীমান্তের মধ্য দিয়ে দেশকে এশীয় মহাসড়কের (এশিয়ান হাইওয়ে) সঙ্গে যুক্ত করবে।
 
চারলেনে উন্নীত করার জন্য চিহ্নিত মহাসড়কগুলোর মধ্যে আছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, সিলেট-তামাবিল-জাফলং, ঢাকা-মাওয়া, মাওয়া-ভাঙ্গা, গাজীপুর-আজমতপুর-ইটাখলা, টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড, ফরিদপুর-বরিশাল ও বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক। এছাড়া আছে ময়মনসিংহ-জামালপুর-শেরপুর, হাটিকুমরুল-রংপুর-বুড়িমারী, টঙ্গী-জয়দেবপুর, হাটিকুমরুল-বনপাড়া-রাজশাহী, বনপাড়া-ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-যশোর, জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-হাটিকুমরুল ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক। উপ-আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মাসুদ হায়দার বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, কাঁচপুর-সিলেট-তামাবিল-জাফলং ফোরলেন প্রকল্পের নকশাও হচ্ছে।
 
বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, বহদ্দারহাট-তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু, জয়দেবপুর-এলেঙ্গা, রংপুর বাইপাস ও নোয়াখালী চৌমুহনীর প্রধান সড়কে ফোরলেন করার কাজ চলছে। নবীনগর-ডিইপিজেড-চন্দ্রা ফোরলেনের কাজ শেষ হয়েছে, তারপরও জটলা। সড়কের পাশে সার্ভিস রোড নির্মাণও জরুরি বলে মনে করছেন অনেকে।
 
এ প্রসঙ্গে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমরা যতই ফোরলেন নির্মাণ করি না কেন মোড়ে মোড়ে ব্লক থাকলে হবে না, দরকার ইন্টারচেঞ্জ। এটা যানচলাচল স্বাভাবিক করতে পারে। ফোরলেনের পাশে সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে। তবেই ফোরলেনে নির্বিঘ্নভাবে যান চলাচল করতে পারবে। অনেকে ফোরলেনের পাশে জমি কিনে বসে থাকেন যাতে বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে ফোরলেনে উঠা যায়, এটা বন্ধ করতে হবে। এজন্যই ফোরলেনের পাশে দরকার সার্ভিস সড়ক।
 
নির্মাণের কয়েক বছর না যেতেই নষ্ট হচ্ছে ফোরলেন। এজন্য অনেকে দায়ী করছেন ওভারলোডিং ট্রাক ও বিটুমিনের ব্যবহার। ওভারলোডেড ট্রাক নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ফোরলেন দ্রুত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর(সওজ)।
 
সওজ জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের বড় মেগাপ্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোরলেন মহাসড়কের উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ২ জুলাই। অথচ উদ্বোধনের দুই বছর না পেরোতেই ১৯২ কিলোমিটার সড়কের বিভন্ন স্থানে বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে বিটুমিন। দেখা গেছে নানা ‘ক্ষত’ ও খানাখন্দ। বর্তমানে মহাসড়কটির বেশ কয়েকটি স্থানে ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় বেশিরভাগ যানবাহনের চালকরা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ রাখতে গতি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। বেশ কয়েকটি স্থানে সওজ ইটের জোড়াতালি দিয়েছে।  

কুমিল্লা সদর উপজেলার আলেখারচর এলাকায় ব্যস্ততম ফোরলেন কুমিল্লা থেকে ঢাকাগামী অংশের কয়েকটি স্থানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে চালকরা যানবাহন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন, গতি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
 
ফোরলেনের কুমিল্লা দাউদকান্দির পদুয়ারবাজার, ইলিয়টগঞ্জ এলাকায় ইট দিয়ে গর্ত ভরাট করে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সচেষ্ট সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ।
 
অন্যদিকে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ১৯২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার সড়ক পরবর্তী পাঁচ বছর মৃসণ ও অক্ষত রাখতে ৯৪৪ কোটি টাকার ‘আবদার’ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর(সওজ)।
 
সওজ গবেষক ও বাংলাদেশ রোড রিসার্স ল্যাবরেটরির পরিচালক ড. মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মূলত ওভারলোডিংয়ের কারণেই ফোরলেন নষ্ট হচ্ছে। আমরা বছরের পর বছর সড়ক মেরামতে টাকা নষ্ট করতে পারি না। তিনগুণ ওভারলোড নিয়ে সড়কে ট্রাক চলাচল করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা অতিরিক্ত ওজন বহন করতে গিয়ে যদি নিজের ঘাড় ভেঙে ফেলি পরে এক কেজিও মাথায় নিতে পারবো না। সড়কের ক্ষতেও একই অবস্থা। ওভারলোডিংয়ে সড়ক ক্ষত-বিক্ষত হলে পরে এই সড়ক মেরামত করা ছাড়া উপায় থাকে না। ফোরলেনের সুফল পেতে হলে ওভারলোডিং ঠেকানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮
এমআইএস/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।