ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

স্কুলের পাশেই মিলছে তামাকপণ্য, ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা 

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৯
স্কুলের পাশেই মিলছে তামাকপণ্য, ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা  স্কুলের পাশে দোকানের সামনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরা, ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: স্কুলের দেয়াল ঘেঁষেই সিগারেটের দোকান। সেই দোকানের সামনে গিয়েই হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলো শান্ত দৃষ্টি। এপাশ-ওপাশ একটু দেখেই পকেটে হাত। তারপর টাকা দিয়ে সিগারেট চাইলো এক স্কুলছাত্র। 

সামনের সুতোয় বেঁধে রাখা লাইটারটি ফস করে জ্বালিয়ে আগুন দিলো হাতের সিগারেটে। এ পর্যায়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে দৌড়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেলো।

এটি ছিল স্কুল সময়ে রাজশাহী মহানগরীর সিরোইল কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের দৃশ্যপট।

কেবল এই স্কুলটিই নয়, রাজশাহী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটি স্কুলের পাশেই তামাক বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। স্কুলের আশপাশের দোকানে সিগারেটসহ তামাক ও তামাকজাত পণ্য বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি এখনও ঘোষণাতেই আটকে আছে!
 
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে স্কুলের পাশেই বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট। এতে জীবনের শুরুতেই মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ছে স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে স্কুল জীবনেই পা বাড়াচ্ছে অন্ধকার জগতে। শখের বসে ধরা সিগারেট থেকে জড়িয়ে পড়ছে অন্য মরণনেশায়, ঝরে পড়ছে অঙ্কুরেই।   

ওই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাহিদুল ইসলাম (ছদ্মনাম) জানায়, স্কুলের তিনলার সিঁড়িঘর ও টয়লেটের পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই সহপাঠীরা ধূমপান করে। স্কুলের বাইরেই সিগারেট পাওয়া যায়। এজন্য ধূমপানকারীদের বেশি দূর যেতে হয় না। এক বন্ধুকে ধূমপান করতে দেখে অন্য বন্ধু উৎসাহিত হয়। এর অপকারিতা তাদের অনেকে জানে অনেকে জানে না। আবার অনেকে জেনেশুনেই ধূমপান করে।  

‘‘ধূমপান মৃত্যু ঘটনায়’ এ কথা জেনেও অপরিণত বয়সে স্কুলের বন্ধুরা এতে আসক্ত হচ্ছে। ধূমপায়ী বন্ধুদের কারণে অধূমপায়ীরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। এতে তাদেরও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। ’
 
এদিকে আইনে বলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শতভাগ ধূমপান মুক্ত। ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭ ধারায় পাবলিক প্লেস-এর কোনো স্থানে যাতে ধূমপানের ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধূমপানের জন্য কোনো স্থানও রাখা যাবে না ।  

২ এর ক ধারানুসারে কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক তিনশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং দ্বিতীয়বার করলে দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হবেন।  

কিন্তু স্কুলের পাশেই তামাক বিক্রয়কেন্দ্র থাকলে এই আইন কখনই বাস্তবায়ন করা যাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  
  
রাজশাহীতে তামাক বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভলপমেন্টের (এসিডি) নির্বাহী পরিচালক সালিমা সারোয়ার বলেন, মহানগর এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার পয়েন্ট অব সেল বা তামাক বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঠিক পাশেই। হাতের কাছে তামাকপণ্য পেয়ে উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীরা ধূমপানে উৎসাহিত হচ্ছে। এজন্য স্কুলের পাশে বিক্রয়কেন্দ্র থাকলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কখনই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।  

তাই আইনের লঙ্ঘন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য গত ১ ডিসেম্বর এসিডির পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে বলে জানান সালিমা সারোয়ার।
 
মাদক ও তামাকের ব্যবহার রোধে ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় একটি অফিস সার্কুলার পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা সার্কুলার বলা হয়, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই মাদক ও ধূমপান বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। ওই কমিটির কাজ হবে মাসে একবার শ্রেণিকক্ষে তামাক বিরোধী সভা আহ্বান করা, মাদক ও তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকারক প্রভাব তুলে ধরে পাঠদান করা, তামাক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও মনিটরিং করা, আসক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের চিহ্নিত করে অভিভাবকদের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে উচ্চ  শ্রেণিতে উন্নীতকরণ বন্ধ থেকে সর্বোচ্চ বহিষ্কার পর্যন্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।

মাদক ও তামাক বিরোধী এই কমিটির সভাপতি হবেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আর সদস্য সচিব হবেন স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক অথবা শারীরিক প্রশিক্ষক। এছাড়া একজন ছাত্র প্রতিনিধি, একজন শিক্ষক প্রতিনিধি ও একজন অভিভাবক প্রতিনিধি থাকবেন।  

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ওই আদেশের পর রাজশাহীর প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই কমিটি হয়েছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রম কাগজ-কলমেই বন্দি হয়ে আছে। দু’একটি স্কুলে এই বিষয়টি মনিটরিং করা হলেও বাকিগুলোর কোনো হদিস নেই।  

জানতে চাইলে রাজশাহী বিবি হিন্দু একাডেমীর প্রধান শিক্ষক রাজেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ‘কমিটি আছে। তবে তার কার্যক্রম একেবারেই যে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, তা ঠিক নয়। পাঠদানের সময় নিয়মিত এই বিষয়ে কথা সম্ভব না হলেও যখনই কোনো অনুষ্ঠান হয় তখনই তামাকের ব্যবহার ও ধূমপানের ক্ষতিকারক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। ’

তবে কমিটি গঠনের পর মাদক ও তামাক বিরোধী মাসিক সভা দু’বার করে আর করা হয়নি বলে জানান প্রধান শিক্ষক।  

এদিকে ২০০৮ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজশাহী মহানগরীকে তামাক মুক্ত ঘোষণার উদ্যোগ নেন তৎকালীন মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। তবে পরে আর সে উদ্যোগ এগোয়নি।
 
এ বিষয়ে সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আমি দায়িত্বে না থাকায় উদ্যোগটি তখন আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে এবার দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজ শুরু করেছি। কোনোভাবেই যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে তামাক বিক্রয়কেন্দ্র না থাকে তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৯
এসএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।