কথাগুলো বলছিলেন, নির্মম হত্যাণ্ডের শিকার ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ছোটভাই রাশেদুল হাসান রায়হান। তার বোনের হত্যার বিচারের রায় নিয়ে কথার প্রসঙ্গে রায়হান বোনকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) রাত ১০ টার দিকে এ মামলার আইনজীবী শাহজাহান সাজুর চেম্বারে আলাপচারিতায় রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিশ্বাস করুণ- একবুক চাঁপা কষ্ট, বেদনায় আমার হৃদয়টা দুমড়েমুচড়ে যায়, প্রতিটি মুহূর্তে মনে পড়ে যায় আপুর কথা, ঘুমের মধ্যে জেগে উঠি আপুর শেষ দিনগুলোর নির্মম কষ্টের কথা মনে হলে, এখনও শেষ রাতে চোখে একফোঁটা ঘুম আসে না আপুর কথা ভেবে’।
এর আগে বিকেলে সোনাগাজী পৌর শহরের নুসরাতের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, নুসরাত যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরে ঢুকতেই দরজার ডানপাশে পড়ার টেবিল। এখনও গোছানো ও পরিপাটি ঘরটি। বিছানাটিও সাজানো গোছানো। শখের ঘড়ি থেকে শুরু করে তার ব্যবহৃত স্টিলের আলমারি আগের মতোই আছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে অর্জিত ক্রেস্টগুলোও আগের মতোই সাজানো।
কথা হয় নুসরাতের মা শিরিন আক্তারের সাথে, কাঁদো কাঁদো কন্ঠে তিনি বলছিলেন, ‘নুসরাতের ঘর সবসময়ই এমন গোছানো থাকতো। পড়ার টেবিল, বিছানাও সে এমন গুছিয়ে রাখতো। লেখাপড়ার বেশ মনোযোগী ছিলো নুসরাত।
বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টায় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ আসামির ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। নুসরাতের মা বলেন, এ রায়ে তিনি সন্তুষ্ট। তবে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন যেন খুব দ্রুত সময়ে রায়টি কার্যকর করা হয়।
এদিকে এ ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির তেজদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে এরই মধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা।
ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ আলোচিত এ মামলার রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দেন।
বিচারক মামুনুর রশিদ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা ফেনী জেলার অন্যতম বৃহৎ বিদ্যাপীঠ। দুই হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী সেখানে অধ্যায়নরত। এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার আলোকজ্জল ভূমিকায় কালিমা লিপ্তকারী এ ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে।
নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় নুসরাত জাহান রাফির তেজদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে এরই মধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। আসামিদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে। তাই দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য। এছাড়া এ ঘটনায় সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম তার পেশাগত তার দায়িত্ব পালনে গাফলতি করেছেন বলেও আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন। এসময় আদালত তাকে তিরস্কার করেন।
রায়ে আরও বলা হয়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আসামিদের পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অত্র মামলার ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফিকে বিগত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টা ৪৫ থেকে ৯টা ৫০ মিনিট মধ্যে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার সাইক্লোন সেল্টারের তৃতীয় তলার ছাদে ডেকে নেওয়া হয়।
এসময় নুসরাতের ওড়না দিয়ে তার হাত-পা বেধেঁ তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত/০৩) এর ৪ (১)/৩০ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেক আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। এছাড়া প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
নুসরাত হত্যাকাণ্ড:
ঘটনার সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২৭ মার্চ। ওইদিন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছিলেন নিহত নুসরাতের মা শিরিন আখতার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তার অনুগত কিছু ক্যাডার জনমত গঠন করে সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য। তারা সিরাজকে মুক্ত করতে রাস্তায় আন্দোলনও করে।
৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে জেলখানায় পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা চালায়।
ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসা হয় নুসরাতের।
এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল ৮ জনকে আসামি করে ও অজ্ঞাতপরিচয় বোরকা পরা চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয় ১০ এপ্রিল। সেদিন রাতেই মারা যান নুসরাত। মৃত্যুর আগে ডাইং ডিক্লারেশন দিয়ে যায় সে- তার সেই ডিক্লারেশনের ক্লু ধরেই এগোতে থাকে মামলা। এক এক করে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।
১১ এপ্রিল নুসরাতকে আনা হয় তার বাড়িতে। সোনাগাজী সাবের পাইলট হাইস্কুল মাঠে নামাজে জানাজার পর সমাহিত করা হয় কবরে। সেদিন নুসরাতের জানাজাটি ছিল লোকে লোকারণ্য। লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশ নিয়ে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে।
এরপর একে একে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ২১ জনকে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ১২ জন। ২৮ মে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আদালত পাঁচজনকে বাদ দিয়ে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে ১৬ জনকে। নুসরাত হত্যায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে। নুসরাতের থানায় হেনস্থা হওয়ার ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই এসআইকে বহিষ্কার করা হয় ৮ মে। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
১০ জুন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এরপর ২০ জুন চার্জ গঠন হয়। ২৭ জুন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়, ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন মোট ৮৭ জন। দীর্ঘ ৪৭ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল যুক্তিতর্ক। চলে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্য দিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তি-তর্ক গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৯
এসএইচডি/ওএইচ/