এ কথাগুলো সেই কিশোর ইমরান হোসেনের। ইমরান এখন এক সাহসী যোদ্ধার নাম।
শখের বসে নানার ট্রলারে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার থেকে ছিটকে পড়ে যায় ওই কিশোর। সাগরে লুঙ্গি ফুলিয়ে ভাসতে ভাসতে ভারতে যাওয়া সেই ইমরান ১৭২ দিন পরে দেশে ফিরে আসে। দীর্ঘ আইনি বেড়াজাল ও কূটনৈতিক যোগাযোগের পর শুক্রবার (১৪ ফেরুয়ারি) তাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বেনাপোল সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে বিকেল ৪টা ২০মিটিটে হস্তান্তর করে। এ সময় তার নানা ও মামা তাকে বেনাপোল থানার মাধ্যমে বুঝে নেয়। ইমরান ছয়মাস পরে ফিরে আসায় আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা তার বাড়িতে ভিড় জমান।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বলেশ্বর নদ ঘেঁষা নানা ইসমাইল খানের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় ইমরানের সঙ্গে।
বর্ণনা দেন সেই বিভীষিকাময় জীবনযুদ্ধের। বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইমরান। সেই ঘটনা মনে আনতেই অজ্ঞানপ্রায় হয়ে পড়ে সে। এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি ইমরান।
ইমরান বাংলানিউজকে বলে, সকাল ৬টার দিকে ট্রলারের সবার খাবারের প্রস্তুতি নিছিল। আমি সবার হাত ধোয়ার জন্য বালতি দিয়ে পানি তুলতে গিয়েই পড়ে যাই। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ট্রলার সরে যায়। গভীর পানিতে ভাসতে থাকি, কয়েক ঘণ্টা যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পরলো ছোটবেলার কথা, মুহূর্তের মধ্যেই লুঙ্গি ফুলিয়ে ভাসতে থাকি। ভাসতে ভাসতে কোথায় গেছি বলতে পারি না। কতদূর যাওয়ার পর ডলফিনের মতো মাছের দেখা মেলে, ভাবছিলাম ওরা আমারে খেয়ে ফেলবে, কিন্তু না... আমারে ওরা কোনো ক্ষতিই করেনি। এভাবেই পার হলো কয়েক ঘণ্টা। এরপর ট্রলারে হাত থেকে ছুটে যাওয়া রশিতে বাঁধা অবস্থায় ফ্লুটসহ বালতি, সেটি ধরে ভাসতে থাকি। ততক্ষণে পর আমার শরীরের শক্তি শেষ হয়ে গেছে। তখন ভাবছিলাম, এখনই বুঝি মারা যাবো, আর মনে হয় দুনিয়ায় থাকতে পারমুনা, মায়ের কাছে যাইতে পারমুনা। এভাবেই চলতে থাকলো কয়েকদিন, ছয়দিনের মাথায় শনিবার (৩১ আগস্ট) ভারতীয় একটি মাছ ধরার এফবি বাবা পঞ্চানন ট্রলারচালক মনোরঞ্জন দাসসহ দুইজন জেলে আমাকে দেখে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার করেন। তখন আমার কোনো হুঁশ (জ্ঞান) ছিল না। ট্রলারে উঠিয়ে আমাকে খাবার দিয়ে সুস্থ করেন তারা। এরপর ভারতের জেলে সমিতিতে নিয়ে যায় আমাকে, সেখান থেকে আমাকে রায়দিঘী থানায় পরে ভোলাহাট থানার নূর আলী মেমোরিয়াল সোসাইটি নামে একটি শিশু যত্ন ও শিশু সুরক্ষা কেন্দ্রে রাখে। দীর্ঘ ছয় মাস হোমে থাকি। ইমরান আরও বলে, সেখানে একবেলা সুজি দু’বেলা ভাত দিত। অনেক কষ্ট করে থাকতে হয়েছে সেখানে। এখনো মাঝেমধ্যে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য চোখে ভাসলে ভয়ে কেঁদে ওঠি।
পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যলয়ের ছাত্র ইমরান, তার বাবার নাম মো. ইয়াহিয়া। তার মায়ের নাম আসমা বেগম। ইমরান যখন দুই মাসে তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
গত ২৬ আগস্ট একটি মাছ ধরার ট্রলারে চড়ে ইমরান সাগরে গেলে সামুদ্রিক ঝড়ে সে ছিটকে পড়ে যায়। ছয়দিন উত্তাল সাগরে সে বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ করছিল। সে খাবে কী? খাওয়ার জন্য তার গায়ের গেঞ্জি দিয়ে ইশারা দিলে ভারতীয় এফবি পঞ্চানন নামে একটি ট্রলারচালক মনোরঞ্জন দাস তাকে উদ্ধার প্রথমে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার রায়দিঘী থানায় ও পরে ভোলাহাট থানার নূর আলী মেমোরিয়াল সোসাইটি নামে একটি শিশু যত্ন ও শিশু সুরক্ষা কেন্দ্রে রাখে। সেখানেই কাটে ইমরানের ১৭২ দিন।
বরগুনার জেলা প্রশাসকসহ তার স্বজনরা তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করেছেন। জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ ইমরানের বেঁচে থাকাকে অলৌকিক এবং এই দিনে দেশে ফেরা দুই প্রতিবেশী দেশের জনগণের ভালোবাসা বলে অভিহিত করেন।
ইমরানের নানা ইসমাইল হোসেন খান বলেন, আমার নাতিকে পেয়ে খুশি। ওর খবর শুনে তো পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ইমরানকে এখন মানসিক ডাক্তার দেখাতে হবে। আমার নাতিকে দেশে আনার জন্য যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০
এএটি