সিরাজগঞ্জ: ছুটির দিন মানেই কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি ঘোচাতে শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়ানো। একটু ফুসরৎ পেলেই কোনো উন্মুক্ত বিনোদন স্পটের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে চায় বিনোদন পিয়াসীরা।
যমুনার নদী বেষ্টিত শহর সিরাজগঞ্জ। হিংস্র যমুনা এক সময় এ জনপদের মানুষের কাছে ছিল অভিশাপ। সেই অভিশপ্ত প্রকৃতি কন্যা যমুনা এখন বিনোদনপ্রেমী মানুষের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। যমুনার পাড়ে শহর রক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্ট ও চারটি ক্রসবার এলাকা এখন অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। এসব বাঁধ এখন বিনোদনপিয়াসী মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়াও হার্ডপয়েন্ট এলাকায় শহীদ শেখ রাসেল শিশুপার্ক এবং অদূরেই নবনির্মিত মুজিব দর্শন ভাস্কর্য উন্মুক্ত এই বিনোদনকেন্দ্রের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ছুটির দিনসহ যেকোনো অবসর সময়ে সিরাজগঞ্জসহ আশপাশের জেলার মানুষগুলোর গন্তব্যস্থল হয় যমুনার পাড়। প্রতিদিনই বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের সমাগমে মুখরিত হয়ে উঠে যমুনার বুকের চারটি ক্রসবার ও শহর রক্ষা বাঁধ।
শুক্রবার (১৯ মার্চ) ও শনিবার (২০ মার্চ) সরেজমিনে যমুনার পাড় ঘুরে দেখা যায়, হাজারও মানুষ যমুনার পাড়ের হার্ডপয়েন্ট ও ক্রসবারগুলোতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছেন নদীর নির্মল বাতাস আর অনাবিল প্রাকৃতিক শোভা। কথা হয় অনেকের সঙ্গেই।
বেসরকারি চাকরিজীবী রাজিব আহমেদ তার বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছেন ক্রসবার বাঁধ-৩ এলাকায়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সারাদিন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাই। তাই ছুটির দিনে প্রকৃতির একরাশ স্নিগ্ধ বাতাস পেতেই এখানে ছুটে আসি।
প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে শহর রক্ষা বাঁধে বেড়াতে এসেছেন শিক্ষক শাহীন আলম। পরিবারের সদস্যদের নির্মল বিনোদনের স্বাদ পাওয়াতেই এখানে নিয়ে এসেছি। এরপর শিশুদের নিয়ে রাসেল পার্কে যাবেন বলে জানান তিনি।
স্বামী ও সন্তানসহ বেড়াতে আসা গৃহিনী ফাহমিদা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, সারাদিনই যন্ত্রের মতো কাজ করতে হয়। ব্যবসায়ী স্বামীও ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন। একটু সময় পেলেই এখানে বেড়াতে নিয়ে আসেন। এখানে আসলে ভালো লাগে। বিশেষ করে বাচ্চারা আনন্দিত হয়।
রিকশা শ্রমিক আমিনুল, সিএনজি অটোরিকশা চালক গোলাম মোস্তফা, অবসরপ্রাপ্ত জুটমিল শ্রমিক আবু বক্কার সিদ্দিক, ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম, হুমায়ুন কবিরসহ বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ, সরকারি-বেসরকারি চাকরীজীবী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এসেছেন উন্মুক্ত এই বিনোদন কেন্দ্রে। কেউ এসেছেন পরিবার পরিজন কেউ বা বন্ধুদের সঙ্গে।
প্রকৃতিপ্রেমী এসব মানুষ বলেন, এক সময় যমুনা নদীর হিংস্রতায় তটস্থ ছিল সিরাজগঞ্জ। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বাঁধগুলো নির্মাণ হওয়ায় একদিকে যমুনার ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে যেমন শহর-তেমনি এ স্থানগুলো হয়েছে দর্শনীয়।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, যমুনার ভাঙন ঠেকাতে ২০০০ সালে প্রায় আড়াই কিলোমিটার সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধটির উত্তরের অংশে নির্মাণ করা হয় একটি বৃত্তাকার হার্ডপয়েন্ট। এই বাঁধের জেলখানা ঘাট সংলগ্ন এলাকায় সিরাজগঞ্জ পৌরসভার তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য শহীদ শেখ রাসেল শিশু পার্ক। তার উত্তরপাশে গত ৭ মার্চ স্থাপন করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বই ভাস্কর্য ‘মুজিব দর্শন’।
এছাড়াও ২০১৭ সালে পানির গতিপথ পরিবর্তনের লক্ষে যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ থেকে আড়াআড়িভাবে চারটি পয়েন্টে চারটি ক্রসবার নির্মাণ করা হয়। এ ক্রসবারগুলোর দৈর্ঘ্য এক থেকে পৌনে ২ কিলোমিটারের মতো। যেটা মূল বাঁধ থেকে লম্বালম্বিভাবে যমুনার মাঝখানে গিয়ে শেষ হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থ রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বাংলানিউজকে বলেন, একসময় সিরাজগঞ্জবাসীর স্বর্বস্ব কেড়ে নেওয়া যমুনা আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় ধ্বংসাত্মক যমুনাকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্মল বিনোদনের স্থান তৈরি করা হয়েছে।
পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এ.কে.এম রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যমুনার ভাঙন থেকে সিরাজগঞ্জকে রক্ষার জন্য নির্মিত হওয়া এসব বাঁধগুলোকে পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাউবোর অর্থায়নে বাঁধের উপরে কয়েক মিটার পরপর নির্মাণ করা হয়েছে বসার আসন। এছাড়াও ক্রসবার বাঁধগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যমুনার পাড়কে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে পাউবো বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শিগগিরই এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যমুনার পাড়কে দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২১
এনটি