ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

শূন্যরেখায় বাজলো ভ্রাতৃত্বের সুর

প্রশান্ত মিত্র, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২১
শূন্যরেখায় বাজলো ভ্রাতৃত্বের সুর

বেনাপোল থেকে: একই ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের বসবাস, ভূ-খণ্ডের হিসেবেও আকাশের নিচে একই জমি। শত-সহস্র বছর ধরে ঘটনা প্রবাহের ফেরে সেই একই জমিকে দ্বিখণ্ডিত করেছে কাঁটাতার।

দূরত্বের সীমারেখা আজ দুটি দেশের আর একগুচ্ছ নিয়মনীতির।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সুযোগে দুটি দেশ মিলেছে আজ উৎসবে। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের শূন্যরেখায় বেজেছে আবারো ভ্রাতৃত্বের জয়গান। খানিকটা সময়ের জন্য হলেও শুভেচ্ছা আদান-প্রদানে আবারো উচ্চারিত হয়েছে বন্ধুত্বের আহ্বান।

শুক্রবার (২৬ মার্চ) মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেনাপোল-পেট্রোপোল সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মধ্যে যৌথ 'রিট্রিট সিরিমনি' অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে জমকালো দৃষ্টিনন্দন যৌথ প্যারেডের মাধ্যমে উপলক্ষটি উদযাপন করা হয়।

এদিন বিকেল থেকেই বিশেষ এই রিট্রিট সিরিমনি উপভোগ করতে দুই দেশের আমন্ত্রিত অতিথিসহ জনসাধারণ বেনাপোল-পেট্রোপোল সীমান্তের শূন্যরেখায় অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী সাধারণ মানুষের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রাণ খুলে। তাদের অনেকেরই কখনো যাওয়া হয়নি কাটাতারের বেড়ার ওপাশে। তবে, ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমের বদৌলতে তরুণদের অনেকেই জানেন পার্শ্ববর্তী দেশ সম্পর্কে। সুযোগ পেলে পাশের বাংলাকে অবশ্যই ঘুরে দেখার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা। কলকাতা থেকে রিট্রিট সিরিমনি উপভোগ করতে আসা স্কুলপড়ুয়া কিশোরী শর্মিষ্ঠা সেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো দিন বাংলাদেশে যাইনি। তবে, দুই দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে আসতে পেরে আমার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি কেমন একটা টান অনুভব করছি।

আড্ডার ছলে তার কাছে আব্দার করা হয় গান গাইতে। অনুরোধ রাখতে গলাছেড়ে গেয়ে উঠেন, "এই বাংলার মাটিতে মাগো জন্ম আমায় দিও"। সর্মিষ্ঠার সুরে মুগ্ধ হয়ে আরেকটি গানের অনুরোধ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে এবার গেয়ে উঠলো "ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরেরে ঠেকাই মাথা। গান শেষে বাংলাদেশ ঘুরতে যাওয়ার আশাও প্রকাশ করেন এই কিশোরী।

অনুষ্ঠান উপভোগ করতে ভারতের উত্তর চব্বিশ পড়গনার হাবড়া থেকে এসেছেন রনি দত্ত ও প্রিয়াঙ্কা দাস। প্রিয়াঙ্কা দাসের মা রানি দাস।  

জানতে চাইলে প্রিয়াঙ্কা দাস বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নাম অনেক শুনেছি বাংলাদেশের তিনি একজন অভাবনীয় নেতা। তার কথা শুনে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী জানতে পেরে আমরা হাবরা থেকে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছি।

কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কথা উঠতেই তিনি বলেন, বাংলাদেশ কেমন সেটা দেখার এবং বাংলাদেশের মানুষ কেমন সেটা দেখার ইচ্ছা থেকেই এখানে এসেছি। শুনেছি বাংলাদেশের মানুষ খুব আন্তরিক। আমাদের ভাষা এবং তাদের ভাষা এক হওয়াই খুব সহজেই আমরা মতবিনিময় করতে পারছি। খুব ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার কাছে বাংলাদেশের কথা শুনেছি তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল, বাংলাদেশের যাবো। অবশ্যই বাংলাদেশে বেড়াতে যেতে চাই। শুনেছি করে বাংলাদেশে দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ, গাছপালা, নদী রয়েছে। আর বাংলাদেশেরর সুস্বাদু ইলিশ প্রতি বছর ভারতে যায়। বাংলাদেশ থেকে যায় বলেই আমরা খেতে পারি।

অনুষ্ঠানে আসা বেনাপোলেরই বাসিন্দা জিসান বলেন, আল্লাহর দুনিয়ায় একই আকাশ, একই মাটি। অথচ আমরা মানুষরা এই মাটি-আকাশকে বিভক্ত করে রেখেছি। ইউরোপের দেশগুলোতে এই বিভাজন উঠিয়ে দিয়েছে, আমরাও স্বপ্ন দেখি একদিন আমাদের মধ্যেও এই কাটাতারের বিভাজন উঠে যাবে। আজকে নো ম্যানস ল্যান্ডে অনুষ্ঠানে আসতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।

এদিকে, আড্ডার মধ্যেই বিকেল ৫টা বাজতে দুই দেশের জন্য আলাদা গ্যালারিতে অবস্থান নেন অতিথিদের। কিছুক্ষণ পরেই গোধূলি লগ্নে দুই বিজিবি-বিএসএফ সদস্যদের অংশগ্রহণে শুরু হয় দৃষ্টিনন্দন প্যারেড। প্যারেড শেষে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে দেয় ভিন্নমাত্রা। পরে বিজিবির যশোর রিজিয়ন কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন ভূঞা বলেন, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের ৫০ বছরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও সম্ভ্রম হারানো ২ লাখ মা বোনকে। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা। আমি বিজিবি এবং আমাদের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতের বিএসফের যারা প্যারেডে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কোভিড সিচ্যুয়েশনের কারণে দীর্ঘদিন এই প্যারেড দীর্ঘদিন বন্ধ ছিলো।

তিনি বলেন, আমাদের মূলনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের বিষয়টিকে আমরা সবসময় মনে করি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক রয়েছে। আজকের এই প্যারেডের মাধ্যমে এই সম্পর্কটিকে আরো উন্নত করার প্রচেষ্টা থাকবে। আমরা প্রত্যাশা করবো এটি আরো সুদৃঢ় হবে।

বিএসএফের ১৫৮ ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট অরুন কুমার বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। বেনাপোল-পেট্রোপোল বন্দরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বন্দর হয়ে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষের যাতায়াত ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চলে। এটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই প্রতিচ্ছবি।

এছাড়া শুক্রবার মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সীমান্তজুড়ে ৫৭৮টি বিওপিতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা ওঠে, দৃশ্যমান হয় বাংলাদেশের মানচিত্র। আর সন্ধ্যায় সামরিক কায়দায় পতাকা নামানোর আয়োজন হয় যাকে বলা হয় ‘রিট্রিট সিরিমনি’।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২১
পিএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।