ঢাকা: রাজধানীর মোহাম্মদপুরসহ পার্শ্ববর্তী আমিনবাজার, তুরাগ, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভারের ত্রাস মো. মোশারফ। এলাকা ভেদে তাকে লম্বু মোশারফ, গলাকাটা মোশারফ অথবা গাঙচিল মোশারফ নামও রয়েছে।
এসব এলাকায় ডাকাতি-ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণ,ভুমিদখল ও মদকের কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধ তার ইশারায় (নেতৃত্বে) চলতো। তার দলে ২৫-৩০ জন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাস সদস্য রযেছে। লম্বু মোশারফে নির্দেশেই তারা নানা অপকর্ম ঘাটাতো।
লম্বু মোশাররফের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক কারবার, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশ অ্যাসল্টসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। তবে নিজের গ্রেফতার এড়াতে বেশ কিছু দিন আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সম্প্রতি সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু অভিযোগের বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে ‘মোশারফ’ বাহিনীর মূলহোতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু ওরফে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাঙচিল মোশারফ ও তার ৫ সহযোগীকে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদকসহ গ্রেফতার করে র্যাব--এর সদস্যরা।
গ্রেফতার অপর আসামিরা হলেন- মো. বিল্লাল ওরফে বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল (৩০), মোহন ওরফে বাইক মোহন (৩১), সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু (৪৪), রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল ওরফে ট্রলার রুবেল (৩৩) ও মো. সুমন মিয়া ওরফে সুমন হোসেন (৩০), অভিযানে তাদের কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৪ রাউন্ড গুলি, ৩ টি বড় ছোরা, ২টি চাপাতি, ২টি চাকু, ১টি চাইনিজ কুড়াল, ১টি দা, ১ টিফ্রেমসহ হেসকো ব্লেড, ১টি গ্রিল কাটার, ১টি কাটার প্লাস, ৪২৩ পিস ইয়াবা, ৫ টি মোবাইল জব্দ করা হয়৷
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফ নিজের গ্রেফতার এড়াতে সে বিভিন্ন সময়ে মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, কাফরুলসহ বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করে থাকতেন। মোহাম্মদপুর এলাকা র্যাবের এক অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী কবির হোসেনকে তার সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয়। কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদে শীর্ষ সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়, পরে ধারাবাহিক অভিযানে গত রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) মোহাম্মদপুর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফ ও তার ৫ সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়।
সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফ রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সাভার হাজারীবাগ, তুরাগ কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় নৌপথ, মার্কেট, বাস স্ট্যান্ড ও হাউজিং প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের নেতৃত্ব দিতেন।
তিনি বলেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায, ২০১৭ সালে গাঙচিল গ্রুপের প্রধান আনারের মৃত্যুর পর গাঙচিল গ্রুপ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ওই সময় লম্বু মোশারফ গাঙচিল গ্যাংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। এরপর লম্বু মোশারফ ও গ্যাঙের একটি অংশের নেতৃত্বে চলে যায়। তারা মোহাম্মদপুর, আমিনবাজার ও তার আশপাশের এলাকায় ও নৌপথে চাঁদাবাজি, ডাকাতি-ছিনতাইসহ মাদক কারবার পরিচালনা শুরু করে। লম্বু মোশারফের নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী দলের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল, হাউজিং- এ চাঁদাবাজি, নৌপথে চাঁদাবাজি, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদক কারবার চালাতেন। শুধু তাই নয়, তারা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালু ভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্যান্য জাহাজ আটকিয়ে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করতেন। এছাড়াও তারা সাভার ও তুরাগ এলাকার বিভিন্ন ইট ভাটার মালিকের কাছ থেকেও মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করতেন। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে লম্বু মোশারফের বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখাতেন এবং হত্যার হুমকিও দিতেন। অনেককে রাতের অন্ধকারে ধরে নিযে যেতেন।
তিনি বলেন, গাঙচিল বাহিনী রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে এক অজানা ভয় ও আতঙ্কের নাম ছিল। কৌশলে মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে কিশোর গ্যাং গ্রুপও নিয়ন্ত্রণ করতেন লম্বু মোশারফ।
র্যাব জানায়, গ্রেফতার লম্বু মোশারফ বরিশালের ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ১৯৯০ সালে জীবিকার প্রয়োজনে সে ঢাকায় আসেন। প্রথমে সে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। পরে সে হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকুরি শুরু করেন। ২০০০ সালে রাজধানী কাফরুল থানাধীন এলাকায় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে ঢোকেন। সেই থেকে গাঙচিল বাহিনীর প্রধান আনার অন্যতম সহযোগী হয়ে যায়। ২০১৭ সালে আনারের মৃত্যুর পর গাঙচিল বাহিনী বিভিন্নভাগে বিভক্ত হয়। বাহিনীর মূল অংশের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন লম্বু মোশারফ।
মোশারফের নামে কীভাবে যুক্ত হলো বিভিন্ন টাইটেল
উচ্চতায় লম্বা হওয়ায় সে ‘লম্বু মোশারফ’ এবং মারামারির সময় ভূক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে তার নাম হয় ‘গলাকাটা মোশারফ’। ইতিপূর্বে গাঙচিল বাহিনীর সদস্য হওয়ায় তার নামের আগে যুক্ত হয় গাঙচিল মোশারফ।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, লম্বু মোশারফের সহযোগী গ্রেফতার বিল্লাল হোসেন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সে ২০০৬ সালে মুন্সিগঞ্জ থেকে পরিবারসহ ঢাকায় আসেন। ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময় লম্বু মোশারফের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ভালো চুরি করতে পারতেন বলে তার নাম হয়ে যায় চোরা বিল্লাল। লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত পান তিনি।
তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই, হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১০টি মামলা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে বলেও যোগ করেন মঈন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার হওয়া মোহন ওরফে বাইক মোহন ২০১০ সালে ভোলা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি, রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে মোটরবাইক চালানোর কাজ করতেন। ২০১৮ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেন। চাঁদা আদায়সহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার সময় লম্বু মোশারফ মোহনের বাইকে চলাচল করতেন বলে সে বাইক মোহন হিসেবে পরিচিত। ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধে ০৮টিরও বেশি মামলায় সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাবাস করেছেন।
অপর দিকে, গ্রেফতার সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বিভিন্ন ট্রলার, জাহাজ চলাচলের সময় এবং রুট তার নখদর্পনে থাকার কারণে সে জলদস্যু সাবু হিসেবে পরিচিতি পান। লম্বু মোশারফের নির্দেশে বুড়িগঙ্গা নদীতে বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য, চাঁদাবাজি, হত্যাচেষ্টা, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে ৬টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
আসামি রুবেল ২০০৬ সাল থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় ট্রলারনৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। ২০১৮ সালে লম্বু মোশারফের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে সে অপরাধ জগতে পারি জমায়। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজিডাকাতির সময়ে সে নৌকা বা ট্রলার চালনা করতেন তিনি। ফলে ট্রলার রুবেল হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় ৩টি মামলা রয়েছে। দলের অপর সদস্য সুমন মিয়া ঢাকার বাবুবাজার এলাকায় বাসিন্দা। তিনি বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি ও ডিসের লাইন লাগানোর কাজ করতেন। ২০২০ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরির সময় লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেন তিনি। লম্বু মোশারফের নির্দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক সংগ্রহ ও মাদক পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মাদক ও চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ২টি মামলা রয়েছে।
এই সন্ত্রসী দলের আরও সদস্য পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে র্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২
এসজেএ/কেএআর/এসআইএস