ঢাকা, বুধবার, ৩১ চৈত্র ১৪৩১, ১৫ মে ২০২৪, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

১২ বছর ধরে ডাকাতি করেন রাজা মিয়া

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০২২
১২ বছর ধরে ডাকাতি করেন রাজা মিয়া

ঢাকা: ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুটকারী চক্রের মূলহোতা রাজা মিয়াসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। চক্রটি গত ১২ বছর ধরেই বিভিন্ন ছদ্মবেশে এ কাজ করে আসছিল।

গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ঢাকার মুন্সিগঞ্জ ও বরিশাল জেলা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৯ দশমিক ৭০ গ্রাম স্বর্ণ ও নগদ তিন লাখ ২৯ হাজার ১৮০ টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার আসামিরা হলেন- মূলহোতা মো. রাজা মিয়া (৫৪), তার সহযোগী মো. কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টার (৪২) ও মো. মাসুদ খান (৪২)।

মঙ্গলবার (০৫ এপ্রিল) দুপুরে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায় রাঙাপরী জুয়েলার্স নামে একটি স্বর্ণের দোকান থেকে প্রায় ৩০০ ভরি স্বর্ণ লুটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাঙাপরী জুয়েলার্সের মালিক আবুল কালাম ভূঁইয়া ভাষানটেক থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব ঘটনার বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও সিসিটিভি ফুটেজসহ বিভিন্ন ঘটে যাওয়া লুটের ঘটনা বিশ্লেষণ করে আসামি শনাক্তের কাজ এবং গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখে। এর ধারাবাহিকতায় সোমবার (৪ এপ্রিল) রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪ এর দুটি বিশেষ টিম মুন্সিগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের মূলহোতা কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টারসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা লুটের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে যে, এর আগেও বিভিন্ন মামলায় র‌্যাবের হাতে আসামিরা একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছিল। এ চক্রটির অপরাধের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, তারা প্রথমে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদপত্র ইত্যাদি ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাদের লক্ষ্যবস্তু দোকানগুলোতে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগদান করে বা দোকান ভাড়া নেয়। পরে স্বর্ণালঙ্কার লুট করার পর তারা আত্মগোপনে চলে যায়। সেই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে সর্বপ্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা কিছুদিন পর নতুন লক্ষ্যবস্তু ঠিক করার জন্য পুনরায় যোগাযোগ করে।

একই পদ্ধতিতে তারা ২০১৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের জয়পুরহাট শাখার ভল্ট ভেঙে এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা লুট করে। এ ঘটনায় তারা ব্যাংকের পাশের একটি ঘর একটি এনজিও’র নামে মিথ্যা পরিচয়ে ভাড়া নেয়। ভল্ট লুটের এক সপ্তাহ আগে থেকে স্কু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেয়াল কেটে ব্যাংকের ভল্টে ডুকে ওই টাকা লুট করে পালিয়ে যায়।

ওই ঘটনায় রাজা মিয়াসহ সাতজন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। ওই ঘটনায় রাজা মিয়া তিন বছর কারাভোগ করেছেন। একইভাবে তারা ২০১৪ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে দু’টি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ৪৫৫ ভরি স্বর্ণ ও দুই লাখ টাকা লুট করে। পরে র‌্যাবের অভিযানে তারা তিনজন গ্রেফতার হয় এবং কারাভোগ করে।

তিনি বলেন, গ্রেফতার আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানিয়েছেন, তারা ২০২০ সালে ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজায় স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ২৩০ ভরি স্বর্ণ ও এক লাখ ৫০ হাজার টাকা লুট করে। সেই ঘটনার দুই মাস আগে এই চক্রের তিন সদস্য মিথ্যা পরিচয়ে একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির গার্ড হিসেবে মার্কেটের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে যোগ দেন। এতদিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে তারা গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম ছিল।

খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আসামিরা আরও জানান, তারা ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের সক্রিয় সদস্য। এ চক্রে তাদের ৮-১০ জন সদস্য রয়েছে।

আসামিরা বিভিন্ন পেশার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানের স্বর্ণের দোকান লুট, ব্যাংক ডাকাতি ও বিভিন্ন মার্কেটে লুট করে আসছিল।

গ্রেফতার কাউসার রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় রজনীগন্ধা মার্কেটে স্বর্ণের দোকান লুটের পরিকল্পনার করে। ঘটনার দেড় মাস আগে ওই মার্কেটে ভুয়া পরিচয়ে একটি দোকান ভাড়া নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তার ভাড়া দোকানে নাম সর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে চুরির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মজুদ করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক লুট চক্রের মূলহোতা রাজা মিয়া ও তার সহযোগী কাউসার মাস্টারসহ অজ্ঞাত আরও তিন থেকে পাঁচজন সদস্য রাত ১২টার দিকে মিরপুর-১৪, গোলচত্বরে একত্রিত হয়। আসামি মাসুদ তাদের রাত একটা নাগাদ মার্কেটে আসতে বলেন। এ সময়ের মধ্যে গ্রেফতার মাসুদ মার্কেটের অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীদের কৌশলে খাবার ও পানীয়ের সঙ্গে চেতনানাশক সেবন করিয়ে তাদের অজ্ঞান করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক অন্যান্যরা মার্কেটের সামনে এলে মাসুদ ও তার এক সহযোগী গেটের তালা খুলে তাদের কাউসারের ভাড়া করা দোকানের ভেতর নিয়ে যান। কাউসার মাস্টার ও তার এক সহযোগী মার্কেটের বাইরের চারপাশ নজরদারিতে থাকেন। পরে রাত দু’টার দিকে কাউসার মাস্টারের দোকান থেকে মজুদ করে রাখা তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটি দোকানের তালা এবং শাটার ভেঙে রাজা মিয়াসহ আরও দুই থেকে তিনজন দোকানের ভেতর প্রবেশ করে। দোকানের ভেতর থাকা স্বর্ণলঙ্কার ও নগদ টাকা লুট করে তাদের ভাড়া করা দোকানে নিয়ে যায়। ঘটনা চলাকালীন সময়ে মাসুদ দোকানের বাহিরে পাহারা দেন। দোকানে যে স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়েছে তা যেন আগে থেকে না বুঝা যায় সেজন্য তারা দোকানে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর তারা ভোরে লুট করা মালামালসহ কেরানীগঞ্জে কাউসার মাস্টারের বাসায় চলে যায়।

গ্রেফতার আসামিরা আরও জানায়, ঘটনার দিন সকালেই তারা লুট করা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যান। এ চক্রের মূলহোতা রাজা মিয়া একজন দক্ষ তালা ভাঙার মেকার এবং অন্যান্যরা বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী। গ্রেফতারকৃতরা খুব সাধারণ বেশ ধারণ করে চলাফেরা করতেন যেন কেউ তাদের কোনো প্রকার সন্দেহ না করে।

কে এই রাজা মিয়া:

গ্রেফতার হওয়া রাজা মিয়া ১৯৯০ সালে বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০২ সালের দিকে বর্ণিত সংঘবদ্ধ চক্রটির সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। সেই থেকেই তিনি অপরাধ জগতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে বাস কন্ডাক্টরির পরিবর্তে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। তিনি অটো রিকশা চালানোর আড়ালে পরিকল্পনামত লুট/ডাকাতির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মার্কেটে রেকি করতেন। রাজা মিয়া একজন দক্ষ তালা-চাবির মেকার। তিনি অর্ধ-শতাধিক চুরি/ডাকাতির ঘটনায় জড়িত বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এ ঘটনায় তিনি দোকানে লুটের পরিকল্পনা করে এবং লুটের সময় স্বর্ণের দোকানে শার্টারের তালা ভাঙার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এর আগেও তিনি চুরি ও ডাকাতি সংক্রান্ত দু’টি মামলায় কারাভোগ করেছেন।

অপর আসামিদের বিষয় র‌্যাব জানায়, গ্রেফতার কাউসার হোসেন মাধ্যমিক সম্পন্ন করে আরআরএমপির একটি প্রকল্পে চাকরি নেন। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকায় এক আইনজীবীর অফিস সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে তিনি। ২০১৮ সালে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের এক সদস্য আদালতে এলে সেখানে কাউসারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই থেকে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের স্বর্ণালঙ্কার লুটে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি অপরাধ এ জগতে ঢোকে। এ ঘটনায় তিনি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। অপরাধ জগতে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এবং ভুয়া সব কিছু তৈরি করতে সিদ্ধ বিধায় তাকে তাদের চক্রের সব সদস্য মিলে মাস্টার উপাধি দেন। অপর দিকে, গ্রেফতার মাসুদ ঢাকার চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ক্লিনার ও বয় হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চাকরি করা অবস্থায় ২০১০ সালের দিকে এ চক্রের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে সখ্যতা গড়ে তোলে। তিনি ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে থাকা অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন হাজী আহসান উল্লাহ সুপার মার্কেটের দু’টি স্বর্ণের দোকানের প্রায় দুই কেজি স্বর্ণ লুট করেন। সেই লুটের ঘটনায় তিনি কারাবরণ করেছেন। তার নামে তিনটি চুরির মামলা রয়েছে।
 
গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০২২
এসজেএ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।