ঢাকা, শনিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভালো নেই সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২২
ভালো নেই সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা

সিরাজগঞ্জ: এক সময় তাঁতের খটখট শব্দে মুখরিত থাকতো সিরাজগঞ্জ ও এর আশপাশের অঞ্চল। সময়ের পরিক্রমায় নানা কারণে সেই জৌলুস হারিয়ে গেছে।

এখন বন্ধ বেশিরভাগ তাঁত। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

সিরাজগঞ্জ জেলাকে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁতশিল্পের নাম সবার আগে আসে। জেলার সবকটি উপজেলায় কমবেশি তাঁত কারখানা রয়েছে। বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলাতে সংখ্যাটা বেশি। জেলার অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম এ শিল্পটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। এ কারণে জেলার ব্র্যান্ডিং ঘোষণা করা হয় তাঁতশিল্পকে।

অথচ বৃহত পরিসরে বিস্তার লাভ করা এই মাঝারি শিল্পটি এখন নানা প্রতিকূলতায় কোনমতে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। সুতা-রঙের মূল্য বৃদ্ধি, কাপড়ের চাহিদা হ্রাস, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা না থাকায় এ শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ছে। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে তাঁত, ভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছেন তাঁত সংশ্লিষ্টরা। ঋণে ঋণে জর্জরিত তাঁতিরা কারখানা বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন।  

জেলার অন্যতম তাঁতপল্লী শাহজাদপুরে উপজেলার রুপপুর গ্রামের সৌদিয়া টেক্সটাইলে ৩০টি তাঁত কারখানা ছিল। বর্তমানে সবগুলোই বন্ধ। এ কারখানার মালিক হায়দার আলী ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, তাঁতের ব্যবসায় প্রতিনিয়ত লোকশান গুনতে গুনতে এখন পুঁজিই হারিয়ে ফেলেছেন।  

একই গ্রামের রহমত আলী অনেক বড় তাঁত ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ঋণের দায়ে সবগুলো তাঁত বিক্রি করার পাশাপাশি নিজের বাড়িও বিক্রি করে দিয়েছেন। তারপরও তাঁর ঋণ শোধ হয়নি। তিনি বলেন, উচ্চসুদের ঋণ, তার ওপর তাঁতের ব্যবসায় উপুর্যপুরি লোকশান তাকে পথে বসিয়েছে।  

উপজেলার হামলাকোলা গ্রামের আবু তালহার অবস্থাও একই। তিনিও সব তাঁত বন্ধ করে অন্য পেশায় ঢুকেছেন।  
 
পুকুরপার শান্তিপুর এলাকার ডায়িং কারখানার মালিক রফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, তাঁতিরা তার কাছ থেকে বাকিতে সুতো ডায়িং করতেন। অনেক তাঁতিই কারখানা বন্ধ করে তার টাকা না দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এতে তিনি নিজেও ঋণগ্রস্ত হয়ে নিজের ডায়িং কারখানা বন্ধ করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।  

রূপপুর, হামলাকোলা ছাড়াও উপজেলার দাবাড়িয়া, রুপনাই, খুকনী, রতনকান্দি, বেলকুচি উপজেলার গোপালপুর, গোপরেখী, বেতিল, এনায়েতপুর, গোপীনাথপুর, তামাই, রাজাপুর, সদর উপজেলার সয়দাবাদ, পঞ্চ সারটিয়া, গাছাবাড়িসহ সকল এলাকার তাঁতপল্লীতেই এখন বিরাজ করছে ত্রাহি অবস্থা।  

চর গাছাবাড়ি এলাকার ২২টি তাঁতের মালিক সেরাজুল ইসলাম বলেন, তাঁতগুলো বন্ধও করতে পারছি না, চালাতেও পারছি না। এক দেড় বছর আগে সুতোর দাম ছিল প্রতি কার্টুন ১৪ হাজার টাকা। এখন সেই সুতার দাম হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে শাড়ির দাম বেড়েছে মাত্র ৫০ টাকা। তার ওপর শাড়ির চাহিদা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।  

বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুতার দাম দিগুন বৃদ্ধির পাশাপাশি রঙ ও সিল্কের দাম সমানতালে বেড়েছে। বেড়েছে বিদ্যুতের দামও। অথচ সে তুলনায় শাড়ির দাম বেড়েছে শতকরা ১০ টাকা। বিক্রিমূল্যে প্রতিটি শাড়ি উৎপাদন খরচও উঠছে না। তাঁতিরা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। একদিকে শাড়িতে লাভ হচ্ছে না তার উপর চড়া সুদ যেন মরার ওপর খড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই তাঁত বিক্রি করে ঋণশোধ করে অন্য পেশা যাচ্ছেন তারা।  

মনি টেক্সটাইলের মালিক ও শাহজাদপুর হ্যান্ডলুম পাওয়ালুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনি খান পান্না বলেন, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য যাচ্ছে তাঁতশিল্প। এক সময়ে জেলায় তাঁতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লাখ। এর মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৪০ শতাংশ তাঁত চালু রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে খুব শিগগিরই বিলুপ্ত হবে তাঁতশিল্প। জেলার ব্র্যান্ডিং হলেও এ শিল্পকে বাঁচাতে নেই বড় কোনো উদ্যোগ। সরকার তাঁতবোর্ড গঠন করলেও এ থেকে সাধারণ তাঁতিরা কোনো উপকার পায় না।  

তাঁতশিল্প মুখ থুবড়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সুতা ও রঙ ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি তাঁতিরা। আমাদের দেশের রঙ উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান না থাকায় এর মূল্য নির্ধারণের কোনো অথরিটি বাংলাদেশে নেই। এ কারণে এ দুটি পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। তার ওপর শিল্প সহায়ক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় লোকাল ঋণের চড়া সুদের যাতাকলে পড়েছেন তাঁতিরা। এসব কারণে উৎপাদিত পণ্যে লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফলে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে তাঁত।  

তিনি বলেন, ভিএসএফ (ভিসকল স্ট্রাপল ফাইবার) নামের সুতা আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না। এ সুতা শুল্কমুক্ত আমদানি ও তাঁতিদের দীর্ঘমেয়াদী প্রণোদনা দিতে হবে। তবেই এ শিল্পে সুদিন ফিরে আসতে পারে।  

বেলকুচি হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বৈদ্যনাথ রায় বলেন, তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে প্রকৃত তাঁতিদের স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান ও তাঁতের উপকরণগুলো শুল্কমুক্ত আমদানির সুযোগ দিতে হবে।

স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে তাঁতিদের সচল করার ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন সিরাজগঞ্জে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সূর্য্য।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।