ঢাকা, রবিবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

ঝালকাঠিতে স্পিড ব্রেকার এখন মরণ ফাঁদ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট     | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৫ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০২২
ঝালকাঠিতে স্পিড ব্রেকার এখন মরণ ফাঁদ

ঝালকাঠি: দুর্ঘটনা যেনো পিছু ছাড়ছে না স্পিড ব্রেকারের জন্য। ঝালকাঠির ওপর দিয়ে চলে গেছে বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক।

এ মহাসড়কের ৫৪ কিলোমিটারে অর্ধশতাধিক স্পিড ব্রেকার রয়েছে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এ  স্পিড ব্রেকারগুলো টপকাতে হয় প্রতিটি যানবাহনকে। মহাসড়ক ছাড়াও জেলার অভ্যন্তরে যাত্রীবাহী ও মালবাহী যান চলাচলের রাস্তায়ও রয়েছে অসংখ্য  স্পিড ব্রেকার।

ঝালকাঠি জেলায় কতগুলো  স্পিড ব্রেকার রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোনো দপ্তরেই। নেই কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানও। এভাবেই ঝালকাঠি জেলার প্রায় সব সড়ক ও মহাসড়কে অপরিকল্পিত আর অবৈধ স্পিড ব্রেকারের দখলে চলে গেছে। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নেই কোন  স্পিড ব্রেকার।  

জানা গেছে, বরিশালের সীমান্তবর্তী কালিজিরা ব্রিজের পশ্চিম পাড় থেকে ঝালকাঠি জেলার এরিয়ার শুরু হয়ে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার সীমান্ত পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। আবার এ সড়কেরই রাজাপুর মেডিক্যাল মোড় থেকে বেকুটিয়া ব্রিজের পূর্বে কাউখালী উপজেলার সীমান্ত পর্যন্ত আট কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। অপরদিকে, জেলার নলছিটি উপজেলার খায়েরহাট ব্রিজ থেকে পটুয়াখালীগামী সাত কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। জেলার মোট ৫৪ কিলোমিটার মহাসড়কে স্পিড ব্রেকার রয়েছে অর্ধশতাধিক। যা গড়ে প্রতি কিলোমিটারে একটি করে স্পিড ব্রেকার রয়েছে।  

সূত্র মতে, সড়ক ও মহাসড়কে বিপুল সংখ্যক স্পিড ব্রেকার কিভাবে বসল তার কোনো তথ্য নেই খোদ সড়ক বিভাগের কাছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক  নেতাদের চাপে এগুলো বসানো হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা প্রায় অসহায়। অথচ সড়ক-মহাসড়কে এভাবে স্পিড ব্রেকার দেওয়ার বিধান নেই। দিক নির্দেশক চিহ্ন এবং পথচারী পারাপারের জেব্রা ক্রসিংয়ের বাইরে এসব সড়কে থাকতে পারে শুধু র‍্যাম্বেল স্ট্রেট (আধা ইঞ্চি উঁচু বিট এক সঙ্গে ছয় থেকে আটটি)। অথচ বিপজ্জনক স্পিড বেকারগুলো বসিয়ে শুধু গাড়ির ক্ষতিই করা হচ্ছেনা, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে কয়েকগুণ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কের পাশে ৫-৭টি দোকান থাকলেই তার দু’প্রান্তে বসিয়ে দেয়া হয়েছে দুটি স্পিড ব্রেকার। কোথাও কোথাও প্রভাবশালী কারো বাড়িতে প্রবেশের শাখা সড়ক কিংবা বিত্তশালী শিল্প মালিকের কারখানার সামনেও তৈরি করে রাখা হয়েছে জোড়ায় জোড়ায় গতিরোধক। যেমনটা দেখা গেছে বরিশাল থেকে ঝালকাঠির পথে আমিরাবাদ, রায়াপুর, ষাটপাকিয়া, ভৈরবপাশা, প্রতাপ, ঢাপড়, সুতালড়ি, পেট্রোলপাম্প মোড় এলাকায়। অবস্থাটা এমন হয়েছে নিয়মনিতীর তোয়াক্কা না করে যার যেখানে ইচ্ছে হয়েছে সেখানেই স্পিড ব্রেকার বসিয়েছে। ঝালকাঠি-রাজাপুর সড়কে নৈকাঠি বাজার সংলগ্ন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সামনে দুইটি স্পিড ব্রেকার বসানো হয়েছিল। যেখানে রাতে এক অটোরিকশা চালক উল্টে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পরে ওই ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মামলার ভয়ে পরেরদিনই স্পিড ব্রেকার তুলে নেয়।  

অথচ বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ্ববর্তী একমাত্র রাজাপুর উপজেলা হাসপাতালের সামনে নেই কোনো স্পিড ব্রেকার। ফলে প্রতিনিয়ত চরম ঝুঁকি নিয়ে ওই এলাকার বাসিন্দা ও হাসপাতালে আগতদের মহাসড়ক পারাপার হতে হচ্ছে। স্থানীয় সচেতন মহল হাসপাতালের সামনের সড়কে জরুরি ভিত্তিতে র‍্যাম্বেল স্ট্রেট নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।

ঝালকাঠি সড়ক বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর বাংলানিউজকে বলেন, সড়কে মসৃন গতিতে যানবাহন চলাচল করবে এটাই মূলত সড়ক ও সেতু বিভাগের নীতি। সড়ক বিধিতে স্পিড ব্রেকার বলতে কিছু নেই। উন্নত দেশগুলোতেও একই নিয়ম বিদ্যমান। তারপরেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় এটা পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হয় না।  

তিনি আরও বলেন, কিছু স্পিড ব্রেকার আমাদের দিতে হয়, কিন্তু যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তার বাইরে চাপের মুখে বা আমাদের অজান্তে বেশিরভাগ স্পিড ব্রেকার বসানো হয়েছে।

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘এক্সপ্রেসওয়ে’ যেমন- ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ফরিদপুরের ভাঙা সড়কে স্পিড ব্রেকার বা জেব্রা ক্রসিং দেওয়ার বিধান নেই। এছাড়া আন্তঃজেলা সড়ক কিংবা মহাসড়কগুলোতেও একেবারে জরুরি না হলে কোনো স্পিড ব্রেকার দেয়া যাবেনা। যদি দিতেই হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সড়ক বিভাগকে চিঠি দিয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে যাচাই করে সেখানে স্পিড ব্রেকার বসানো হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি ঝালকাঠির ক্ষেত্রে এসব বিধিবিধানের কোনোটিই মানা হচ্ছে না। এখানে যে যার মতো করে স্পিড ব্রেকার বসাচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে যাতায়াতে এটা যে কতোটা ক্ষতিকর তা কেউ বিবেচনা করে দেখছেন না।

ঝালকাঠি আন্তঃজেলা বাস ও মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, বরিশাল থেকে ঝালকাঠির দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার। এইটুকু সড়কে ২৭টি স্পিড ব্রেকার থাকায় যানবাহনের চালকরা গাড়ি চালাতে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এমনতিই আমাদের দেশের স্পিড বেকারগুলো কোনো নিয়ম-কানুন মেনে তৈরি হয়না। কোথাও আবার উঁচু করে বানানো হয়েছে স্পিড ব্রেকার।

তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিত এসব স্পিড ব্রেকারের আগে ও পরে কোনো সতর্ক সংকেত কিংবা স্পিড ব্রেকারে কোনো রং না দেয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে রাতে কিংবা বরিশালের বাহির থেকে আসা যানবাহনগুলোকে প্রায় দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মোটরসাইকেল চালকরা।

ঝালকাঠি জেলা মানবাধিকার কমিশনের সাধারণ সম্পাদক আবু সাইদ খান বলেন, যেখানেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে সেখানেই স্পিড ব্রেকার নির্মাণের দাবি ওঠে। আসলে স্পিড ব্রেকার সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো সমাধান নয়। সবার আগে দরকার সচেতনতা। স্পিড ব্রেকার না থাকলে যেমন মানুষ দুর্ঘটনা কবলিত হয়, তেমনি স্পিড ব্রেকার দিলেও দুর্ঘটনা ঘটে। এমনকি যানবাহনেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই সড়ক ও মহাসড়ক থেকে স্পিড ব্রেকারগুলো সরানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।  

ঝালকাঠি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মো. নাবিল হোসেন জানান, মহাসড়কের বা অভ্যান্তরীণ রাস্তায় স্পিড ব্রেকারের যে বিধি রয়েছে তাতে খুব জরুরি কয়েকটা ছাড়া দেয়া যায় না। কিন্তু যেখানেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে সেখানেই স্পিড ব্রেকার নির্মাণের দাবি ওঠে। তাই ওই সময়ে জনরোষ সামলাতে স্পিড ব্রেকার দেয়া হয়। আবার অনেক স্থানে স্থানীয়ভাবে আমাদের না জানিয়ে স্পিড বেকার স্থাপন করা হয়। যে জন্য পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হচ্ছে না।  

তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতু ও বেকুটিয়া সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্পিড বেকার সংক্রান্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যদি কোন নির্দেশনা আসে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবো।  

বাংলাদেশ সময়: ২০২২ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।