ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পদ্মা সেতু: মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বাড়বে, হবে লাখো কর্মসংস্থান

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৪ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২২
পদ্মা সেতু: মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বাড়বে, হবে লাখো কর্মসংস্থান মোংলা বন্দর।

বাগেরহাট: চলছে কাউন্ট ডাউন, আর মাত্র পাঁচদিন পরেই চালু হবে কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু।  

পদ্মা সেতু চালু হলে বিচ্ছিন্নভাবে লাভবান হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।

তৈরি হবে নতুন নতুন অবকাঠামো ও সৃষ্টি হবে কর্মক্ষেত্র। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে সড়ক পথে স্থাপন হবে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, কমবে রাজধানীতে যাতায়াতের সময়। ফলে এককভাবে সব থেকে বেশি লাভবান হবে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা।  

এই সেতুর ফলে রাজধানী ঢাকা থেকে সব থেকে কাছের সমুদ্র বন্দর হবে এটি। মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বাড়বে কয়েকগুন। মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে। সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে এই অঞ্চলের। বদলে যাবে মোংলা-রামপাল এলাকার অর্থনীতি। নতুন-নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর্থিকভাবে লাভবান হবেন ব্যবসায়ী, বন্দর ব্যবহারকারী ও স্থানীয়রা।

মোংলা বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর হাওয়া ইতোমধ্যেই মোংলা বন্দরে লেগেছে। বন্দর এলাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য জমি ক্রয় শুরু করেছে। অনেকেই জমি লিজ নেওয়ার জন্য বন্দরের দারস্থ হচ্ছে। যারা জমি ক্রয় করতে পারেনি, তারাও ভাড়া বাড়িতে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অফিস স্থাপন করছে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুকে ঘিরে মোংলা বন্দর এলাকায় চলছে মহাকর্মযজ্ঞ।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, খুলনা বিভাগে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত মোট বিনিয়োগ করেছে ১০৩টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এতে ২৩৪৬০.৬৮৩ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থ বছরে বিনিয়োগ করেছেন ৩১টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১৩৪৫২.৭৯১ মিলিয়ন টাকা। এর বেশিরভাগই হয়েছে মোংলা এলাকায়।

মোংলা এলাকার বাসিন্দা আলী আজম খান বলেন, কয়েক বছর আগেও দিগরাজ থেকে বন্দর পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণ খালি জায়গা ছিল। এখন কাটাখালী থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের বেশিরভাগ জমিই বড় বড় শিল্প গ্রুপ ক্রয় করেছে। কেউ ভূমি উন্নয়ন করছে, ভবনের কাজ করছে। সব মিলিয়ে এলাকায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এসব পদ্মা সেতুর ফলেই হচ্ছে।

বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের বন্দর বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আহসান আরজু বলেন, মোংলা বন্দর থেকে আমদানি পণ্য আরিচা ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকায় নিতে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। পদ্মা সেতু চালু হলে, মোংলা থেকে ঢাকায় একটি গাড়ি নিতে ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে। ফলে আমরা যেদিন গাড়ির অর্ডার পাব, সেই দিনই ক্রেতার হাতে গাড়ি দিতে পারব। সময় বাঁচার পাশাপাশি, গাড়ি প্রতি ব্যয়ও কমবে ব্যবসায়ীদের। এই সুবিধার জন্য বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের ৩শ সদস্য মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি করবেন বলে দাবি করেন তিনি।

মোংলা কাস্টমস হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ নেয়াজুর রহমান বলেন, মোংলা বন্দর দিয়ে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তার ৫২ শতাংশ আসে আমদানি করা গাড়ির কর থেকে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই রাজস্বের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি লিয়াকত হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী হবে। পদ্মা সেতু চালুর পর মোংলা বন্দর থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় কয়েকগুন বাড়বে। সব চেয়ে বেশি উপকার পাবে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে মোংলা বন্দর এলাকায় ছোট-বড় মিলে ৩৮৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধুমাত্র পদ্মা সেতুর কারণে আরও বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান এখানে জমি ক্রয় করেছেন। তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ চলমান রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে শিল্প বিপ্লব শুরু হবে। বেকারত্ব দূর হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে কয়েক লাখ মানুষের।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মূসা বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি এই এলাকায় নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হবে।  ইতোমধ্যে বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ব্যবসায়ীদের এমন আগ্রহের মূল কারণ হচ্ছে ঢাকা থেকে এ বন্দরের দূরত্ব হবে ১৭০ কিলোমিটার। অপরদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ঢাকার দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার এবং পায়রা বন্দর থেকে ঢাকার দূরত্ব ২৭০ কিলোমিটার। সময় এবং ব্যয় বাঁচাতে ব্যবসায়ীরা আরও বেশি এই বন্দর ব্যবহার করবে। এজন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্য কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। ৬ হাজার ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘আপগ্রেডেশন অব মোংলা পোর্ট’ শীর্ষক প্রকল্প চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। এসব কাজ শেষ হলে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা কয়েকগুন বাড়ার পাশাপাশি রাজস্ব আয় কয়েকগুন বেড়ে যাবে। অচিরেই মোংলা বন্দর আন্তর্জাতিক বন্দরে রূপান্তরিত হতে চলেছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দর ব্যবহারের চাহিদা ও গুরুত্ব বেড়ে যাবে, একই সঙ্গে রেল লাইন চালু হতে যাচ্ছে, ফলে এই অঞ্চলের পুরো চিত্র-ই বদলে যাবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল।

মোংলা বন্দরের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প সমূহ: মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বর্তমানে বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘স্ট্র্যাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর মোংলা পোর্ট’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। যা দিয়ে দিনে ৫০ লাখ লিটার সুপেয় পানি সরবরাহ করা যাবে বন্দর ব্যবহারকারীদের মাঝে। কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৪৩৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ চলছে। চ্যানেলের নিরাপত্তা, সমুদ্রগামী জাহাজ সুষ্ঠুভাবে হ্যান্ডলিং এবং জরুরি উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৭৬৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে  ৬টি জলযান সংগ্রহ কাযক্রম চলমান রয়েছে। পরিবেশবান্ধব বন্দর নিশ্চিত করতে ৪শ এক কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে  ‘মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও নিঃসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্প চলমান রয়েছে।  মোংলা বন্দরের জেটি পর্যন্ত ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিং এর সুবিধা সৃষ্টির জন্য ইনার বার এলাকায় ৭৯৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ২১৬.০৯ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং এর কাজ চলছে। ৪১২ কোটি টাকা ব্যয়ে  মোংলা বন্দরের ২টি অসম্পূর্ণ জেটি নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে। এছাড়াও ৬ হাজার ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘আপগ্রেডেশন অব মোংলা পোর্ট’ শীর্ষক প্রকল্প চালুর অপেক্ষায় রয়েছে।

মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানির তথ্য: ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি শুরু হয়। ওই বছর গাড়ি এসেছিল মাত্র ২৫৫টি। চলতি অর্থ বছরে (২০২১-২২) মে মাস পর্যন্ত এ বন্দর দিয়ে ২০ হাজার ৯টি গাড়ি আমদানি করা হয়েছে।

মোংলা বন্দরের লাভের হিসাব: ১৯৯০-৯১ অর্থ বছর থেকে ২০০১-০২ অর্থ বছর পর্যন্ত বন্দরটি ধারাবাহিকভাবে লাভজনক ছিল। তবে ২০০২-০৩ থেকে ২০০৬-০৭ অর্থ বছর পর্যন্ত লোকসানের শিকার হয় বন্দরটি। এরপর ২০০৭-০৮ অর্থ বছর থেকে আবারও লাভের মুখ দেখে মোংলা বন্দর। ৭০ বছরের রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩৪০ কোটি টাকা লাভ করেছে। এ সময়ে ৯৭০টি বাণিজ্যিক জাহাজ ভিড়েছে মোংলা বন্দরে। ১৪ হাজার ৪৭৪টি গাড়ি এবং ৪৩ হাজার ৯৫৯টি টিইউএস (২০ফুট দৈর্ঘ্যের একটি কনটেইনার) কনটেইনার খালাস ও বোঝাই হয়েছে এই বন্দর থেকে।

১৯৫০ সালে পশুর নদীর জয়মনির ঘোলে চালনা এ্যাংকারেজ পোর্ট নামে মোংলা সমুদ্র বন্দরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ ‘দি সিটি অব লিয়নস’ সর্বপ্রথম এই বন্দরে এসেছিল। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মোংলা বন্দর বর্তমানে একটি জনপ্রিয় ও অন্যতম বন্দর হিসেবে পরিণত হয়েছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।