ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বানা বুনে সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে নাছিমার

সাজিদুর রহমান রাসেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫২ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২২
বানা বুনে সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে নাছিমার

মানিকগঞ্জ: দরিদ্রতা ছিল নিত্যদিনের একান্ত সঙ্গী। অভাব আর অসচ্ছলতায় দিন কেটেছে বহু বছর।

সংসারে অভাব আর দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গৃহস্থলী কাজের পাশাপাশি শুরু করেন বাঁশের তৈরি বানা বোনার কাজ। এই কাজের মধ্য দিয়ে সংসারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসেছে নাছিমা বেগমের।  

নাছিমা বেগম জেলার ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী জাবরা এলাকার বাসিন্দা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার স্বামী রিকশা চালকের কাজ করে সংসার চালাতো। ওই সময় আমাদের খুব কষ্ট হতো। মেয়েরা বড় হতে থাকলো তখন অনেক কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নেই আমার কিছু একটা করতে হবে। আমাদের বাড়ির পাশে এই বাঁশের তৈরি বানার কারখানা দেখি এবং অনেক ভেবে চিন্তে কাজ শুরু করি। এখন প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা আয় করি শুধুমাত্র বানা বুনেই।  

তিনি আরও বলেন, অবসর সময়ে এই কাজের সহায়তা করে কলেজ পড়ুয়া আমার বড় মেয়ে। শুধু মাত্র বানা বুনেয়ে আমরা মা–মেয়ে মাসে আয় করি প্রায় ২০ হাজার টাকা। এখন ঘরে বাইরে আমার যে টাকা আয় করি তাতে সংসারে খরচ করার পরও বেশকিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারি।  

জানা যায়, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী জাবরা এলাকায় চারটি বাঁশের বানা তৈরির কারখানা রয়েছে অথচ ওই কারখানার ওপর ভর করে সাবলম্বী হয়েছে প্রায় আড়াই শতাধিক পরিবার। গুনগত মান ভালো হওয়াতে বেশ চাহিদা রয়েছে এই বানার। ঢাকা, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, বরিশাল, ভোলাসহ প্রায় ২২টি জেলার পাইকাররা এসে নিয়ে যায় এই বাঁশের তৈরি বানা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলার ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম জাবরা, এই গ্রামের রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে চারটি বাঁশের তৈরি বানার কারখানা। ১৯৯০ সালে প্রথম এই বাঁশের তৈরি কারখানা স্থাপন করেন জাবরা এলাকার অক্ষয় রাজবংশীর ছোটো ছেলে মাদারী রাজবংশী। মাদারী রাজবংশীর সেই কারখানা বন্ধ হতে দেয়নি তার উত্তরশরীরা। তারপর থেকে ছোট পরিসরে চলে এই বানা তৈরির কারখানা। পরিশ্রম কম কিন্তু লাভ আশানূরুপ হওয়াতে তার দেখা দেখি অনেকেই এই কারখানা স্থাপনে মনোনিবেশ করেন।  

জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে জাবা, কালি জাবা বাঁশ কিনে আনেন এ সব কারখানার মালিকরা তারপরে বানার আকৃতি বুঝে করাত দিয়ে কাটে ওই সকল বাঁশ। কাটা বাঁশগুলোকে বেতিতে রূপান্তিত করে বানা বুনানোর জন্য উপযোগী করা হয়। বেতিগুলো রোদে শুকানোর পর আশেপাশের বাড়ি ঘরের নারীদের কাছে দিয়ে আসে কারখার মালিকরা। শুকনো বেতিগুলো প্রথমে সারিবদ্ধভাবে মাটিতে রাখে। সারিবদ্ধ বেতিগুলোকে কট সুতা দিয়ে বুনানোর কাজ শুরু করে এবং এক জন নারী প্রতিদিন প্রায় ১০টি বানা বুনাতে পারে। আকৃতি ভেদে ওই নারীদের দেওয়া হয় মজুরি এবং বিক্রিও হয় আকৃতি ভেদে।

মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে পড়ুয়া বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রী রিমা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, কলেজ ছুটির পর যেটুকু অবসর সময় পাই সেই সময়টা অবহেলায় নষ্ট না করে মায়ের সঙ্গে বানা বুনার কাজ করি। প্রতিদিন আমি গড়ে চারটি বানা বুনতে পারি। এতে যে টাকা পারিশ্রমিক পাই সেই টাকা দিয়ে কলেজ খরচ, প্রাইভেট ও আমার হাত খরচ হয়ে যায়। সবকিছু করার পরও আমার কাছে যে টাকা থাকে সেই টাকা পরিবারের খরচ করার জন্য মায়ের হাতে তুলে দেই।  

জাবরা এলাকার আরেক নারী সেলিনা বেগম বলেন, বাড়ির কাজের পাশাপাশি দুই বছর ধরে এই বানা বুনানোর কাজ করছি। লেখাপড়া জানি না যে কারণে কোনো জায়গাতে আমাগো চাকরি হইবো না। চাকরি করলে তো সারাদিন সংসারের সব কাজ করা সম্ভব না তবে সব কাজ শেষ করে অবসর সময়ে এই বানা বুনানোর কাজটা করি। কারখানার মালিকরা যদি আমাগো মজুরিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিতো তবে ভালো হতো।

বাঁশের তৈরি বানা কারখানার মালিক কমল রাজবংশী বাংলানিউজকে বলেন, আমি এই বানা তৈরির সঙ্গে ১৭ বছর ধরে আছি। প্রথমে আমার কাকা মাদারী রাজবংশীর দেখা দেখি এই ব্যবসায় আসি। আমার পরেও অনেকে এসেছে এই ব্যবসায় তবে পরিশ্রম কম লাভ বেশি ছিল। এখন বাঁশের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাঁশ নাই আমাদের জেলায। এই বাঁশের জন্য বাহিরের জেলাগুলোতে যেতে হয় আবার বাঁশের দামও অনেক বেশি। ১০-১৫ ফিট একটি বানা তৈরি করতে চারটি বাঁশ প্রয়োজন যার মূল্য প্রায় ৬৫০ টাকা, শ্রমিকের মজুরি দিয়ে ওই বানায় খরচ পড়ে প্রায় হাজার টাকা। আমরা পাইকারের কাছে বিক্রি করি ১২শত থেকে ১৪শত টাকা। আমার এই কারখানা থেকে দেশের প্রায় ১৭টি জেলায় পাইকাররা এ বানা নিয়ে যায়।

বানিয়াজুরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস আর আনসারী বিল্টু বাংলানিউজকে বলেন, আমার এই ইউনিয়নের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এই জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের প্রায় ২২টি জেলার পাইকাররা এসে বানা নিয়ে যায়। ৯০ দশকে প্রথম এই শিল্প আমার এই অঞ্চলে আসে তারপর থেকে এই বানা তৈরির সঙ্গে অনেক পরিবার জড়িয়ে রয়েছে। নারীরা বিশেষ করে সংসারের কাজ শেষ করে অবসর সময় টুকু এই বানা তৈরি করে অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী হয়েছে তারা। সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এ বানা তৈরির জন্য আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে তাহলে এই এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ বানা শিল্পের আরও ব্যাপক প্রসার ঘটবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।