ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

নাটোরে শিক্ষিকার মৃত্যু নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০২২
নাটোরে শিক্ষিকার মৃত্যু নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা

নাটোর: নাটোরে কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করা নিয়ে ভাইরাল হওয়া আলোচিত শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের মৃত্যু নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলছেন বিষয়টি আত্মহতা আবার কেউ বলছেন হত্যাকাণ্ড।

কিন্তু পুলিশ পাচ্ছে না কোনো কুল কিনারা। সময় যতই গড়াচ্ছে শিক্ষিকার মৃত্যু নিয়ে ততই গুঞ্জন বইছে সব মহলে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও গণমাধ্যমে এ নিয়ে চলছে একের পর এক আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে বলেছেন শিক্ষিকার মৃত্যুর জন্য মানসিক চাপই দায়ী। কারণ তাদের অসম প্রেম এবং বিয়ের বিষয়টি গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হোক তা কখনও চাননি ওই দম্পত্তি। কিন্তু শেষ পরিনতিতে তাই হয়েছে। সম্প্রতি তাদের বিয়ের বিষয়টি ভাইরাল হলে ওই শিক্ষিকার মানসিক চাপ ও হতাশা বেড়ে যায়। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী থেকে শুরু করে পরিচিতরা সবাই বিষয়টি নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করেছেন।

এছাড়া নতুন স্বামী মামুনের অসংলগ্ন কথাবার্তা, মাদকাসক্ত হওয়া ও মোটরসাইকেল কেনার জন্য চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন মানসিক চাপ নিয়ে দিন কাটছিল খায়রুন নাহারের।

এর আগে ওই শিক্ষিকার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। পারিবারিক কলহে সেই সংসারও টেকেনি। প্রথম স্বামীর ঘরে তার দুই ছেলে সন্তান আছে।

প্রথম সংসারে বিচ্ছেদের পর খায়রুন নাহার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে কাটাতিন তিনি। এর মধ্যেই এক বছর আগে ফেসবুকে তার সঙ্গে নাটোর এনএস কলেজের ছাত্র মামুনের পরিচয় হয়। মামুনের সঙ্গে কথা বলে তিনি শান্তি অনুভব করতেন। আর মামুনও তার পাশে থেকে জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। এর ছয় মাস পর তাদের দুইজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে তারা বিয়ের সিন্ধান্ত নেন।

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর তারা গোপনে বিয়ে করেন। সেটি ছেলের পরিবার মেনে নিলেও মেয়ের পরিবার থেকে মেনে নেয়নি। তাই নাটোর শহরে তারা ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। পরে হঠাৎ করেই সেই শিক্ষিকা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

বিষয়টিতে পুলিশ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজসহ সবার একটাই ধারণা করছেন যে, মানসিক চাপের কারণে শিক্ষিকা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। আবার অনেকে বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন মতামত দিয়েছেন। কারণ স্বামী মামুনের নানা অসংলগ্ন কথাবার্তা, আচরন ও চলাফেরা নিয়ে তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়।

ভাড়া বাসার কেয়ারটেকার নিজামুদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের স্বামী মামুন শনিবার (১৩ আগস্ট) রাত ১১টার দিকে বাসায় প্রবেশ করেন। গেট লাগিয়ে তিনি পাশের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। পরে রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে বাসার গেটে ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে তিনি এগিয়ে যান। তখন মামুন ওষুধ আনতে বাইরে যাবেন বলে বের হন। এর পর ভোর ৬টার দিকে তিনি আবার বাসায় ফেরেন।

তিনি আরও জানান, বাসায় যাওয়ার ৫ মিনিট পরেই মামুন তাকে ওপরে ডাকেন। তার কথামতো ওপরে গিয়ে বেড রুমে শিক্ষিকার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। আর খাটের ওপরে চেয়ার এবং সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নার একটা অংশ ঝুলতে দেখেন। সন্দেহ হলে তিনি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে বাড়ির মালিককে বিষয়টি জানান।

বাড়ির মালিক তানভির আহমেদ সিদ্দিকী জানান, কেয়ারটেকার নিজামুদ্দিন তাকে ঘটনাটি বলার পর তাদের ঘরে গিয়ে মরদেহের পাশে মামুনকে দেখতে পান। এর পর তিনি ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে পুলিশে খবর দেন। চার মাস আগে তারা তার বাড়ির চতুর্থ তলার একটি ইউনিট ভাড়া নেয়। তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ হয়েছে বলে শোনেননি তিনি। তবে তাদের কাহিনী ভাইরাল হওয়ার পর কিছুদিন তারা এখানে ছিলেন না।

এদিকে বাড়ির কেয়ারটেকারের দেওয়া ভাষ্যের সঙ্গে মামুনের কথার অমিল থাকায় এবং অসংলগ্ন কাথাবার্তা বলায় অনেকেই সন্দেহের আঙুল তুলেছেন তার দিকে। মামুনকে মাদকাসক্ত বলেও দাবি করেন অনেকে।

শিক্ষিকার চাচাতো ভাই সাবের হোসেন বলেন, সকালে ফোনে জানতে পারি যে আমার বোন নাকি আত্মহত্যা করেছেন। খবর পেয়েই আমি গুরুদাসপুর থেকে ছুটে আসি। এসে দেখি বোনের মরদেহ মেঝেতে পড়ে আছে। মরদেহের গলায় কিছু দাগ রয়েছে। এতে মনে হচ্ছে ঘটনাটি আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত খুন। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।

খাইরুন নাহারের দুলাভাই জয়নাল বলেন, খাইরুনের মনে শান্তি ছিল না। এই বিয়েটা করার পর থেকেই সবাই তাকে ছি ছি করত। মুখে হাসিমাখা থাকলেও মনে শান্তি ছিল না। আর যাকে বিয়ে করেছে সেই মামুন ছেলেটাও ভালো না।

শিক্ষিকা খাইরুনের ভাতিজা নাহিদ হোসেন জানান, মামুন মাদকাসক্ত। বিয়ের পর থেকে তিনি আমার ফুফুর কাছে থেকে ৫ লাখ টাকা এবং একটি মোটরসাইকেল নিয়েছেন। সম্প্রতি আরও দামি মোটরসাইকেল চেয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে খায়রুন নাহার মানসিকভাবে চাপে ছিলেন। তার বাইরেও তিনি বিভিন্ন চাপ ও অশান্তিতে ছিলেন।

খুবজীপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, খাইরুন নাহার তার কলেজের শিক্ষকা ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আসতেন। কলেজ থেকে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন করা হয়নি। অধ্যক্ষ হিসেবে তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোনো কথা হয়নি।

নাটোর জেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) আক্তার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষিকা তার সহকর্মীদের ব্যাপারে কোনো দিন কোনো রকম অভিযোগ করেননি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হলে পরে এ নিয়ে কথা বলবো।

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেই বলেছেন, তাদের বিয়ের বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার কারণে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। পরিবারসহ সহকর্মী এবং আত্মীয় স্বজনরা বিষয়টিকে নেতিবাচক ভাবে দেখেছেন। অনেকেই কুরুচিপুর্ণ মন্তব্য করেছেন। ফলশ্রুতিতে শিক্ষিকা মানষিকভাবে ভেঙে পড়েন। এ জন্যই তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। বলা যায়, বাজে মন্তব্যের কাছেই তিনি ঠেকে গেছেন। আর খায়রুন নাহারের মতো পরিস্থিতি যেন না হয় সেই জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। চাইলেই সব কিছু ভাইরাল করা ঠিক হবে না।

পুলিশ হেফাজতে থাকা শিক্ষিকার স্বামী মামুন জানান, নামাজ পড়ার জন্য তিনি রাতে বাহিরে গিয়েছিলেন। সকালে স্ত্রীকে তার কর্মস্থলে পৌঁছানোর কথা ছিল। নামাজ পড়তে যাওয়ার পর খাইরুনকে ফোন করলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ফিরে এসে দেখি তিনি ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে ঝুলে আছেন। পরে হাসুয়া খুঁজে না পেয়ে ওড়নায় গ্যাস লাইটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তাকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নিচে নামিয়ে রাখি। এ সময় তার হাতে আগুনের ফোসকা পড়ে।

তার স্ত্রীর আত্মহত্যার কারণ জানতে চাইলে মামুন বলেন, তারা ৮ মাস আগে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে তার (স্ত্রীর) মন ভালো দেখিনি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের কাছে থেকে প্রায় তিনি খারাপ ব্যবহার দেখতেন। অনেকেই তাকে ফোন করে বলতো যে, কেন হাঁটুবয়সি বা ছেলের বয়সি  একজনকে বিয়ে করেছিস। তাকে সবসময় মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। এ জন্য তার স্ত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বাংলানিউজকে বলেন, সবার আড়ালে অসম প্রেমের পর বিয়ে করে তারা সুখেই সংসার করছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তাদের অসম প্রেম এবং বিয়ে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়। এর পর থেকেই তারা পরিবার ও সামাজিকভাবে চাপে ছিলেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কারণেই ওই শিক্ষিকা আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। প্রাথমিকভাবে আমরা তার স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছি। পরে ময়নাতদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।

এদিকে শিক্ষিকার মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও চলছে নানা গুঞ্জন আর সমালোচনা। ফেসবুকে পরিচয়ের পর ছয় মাস প্রেম, তারপর বিয়ে করেন তারা।

বিয়ের বিষয়টি সামনে আসার পরে সংবাদমাধ্যমকে খাইরুন বলেছিলেন, প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আত্মহত্যা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মামুন আমার খারাপ সময়ে পাশে থেকে উৎসাহ দিয়েছে এবং নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। পরে আমরা দুইজন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই।

হঠাৎ করেই থেমে যায় তাদের সুখের সেই গন্তব্য। মাত্র ছয় মাস আগে মামুন নামের কলেজছাত্রকে বিয়ে করা অধ্যাপক মোছা. খাইরুন নাহারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। বিষয়টি হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা জানতে গ্রেফতার করা হয় স্বামী মামুন হোসাইনকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০২২
এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।