ঢাকা, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১২ মে ২০২৪, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

কপ২৭: স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ১৬ দাবি টিআইবির

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২২
কপ২৭: স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ১৬ দাবি টিআইবির

ঢাকা: তহবিল সংকটের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে উন্নত দেশগুলো ব্যর্থ হয়েছে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত।

কপ২৭ জলবায়ু সম্মেলন সামনে রেখে মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) ইউক্রেন যুদ্ধপ্রসূত অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে হবে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতি দেন।

তিনি বলেন, প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানে উন্নত দেশসমূহ ব্যর্থ হয়েছে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। জলবায়ু তহবিল ‘উন্নয়ন সহায়তার বাড়তি’ এবং ‘নতুন ও অতিরিক্ত’ হলেও কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই উন্নয়ন সহায়তার সাথে জলবায়ু অর্থায়নকে মিলিয়ে গত দুই বছরে তারা মাত্র ৮৩.৩ বিলিয়ন প্রদান করেছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল। উন্নত দেশগুলোর বাধার কারণে ২০২১ সালের জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা তহবিল গঠন করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহে খাদ্য-নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসংক্রান্ত কার্যক্রমে তারা সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় প্যারিস চুক্তির আলোকে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, প্রশমন ও অর্থায়নকে গুরুত্ব প্রদান করে আসন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে তাদেরই স্বার্থে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু অর্থায়নের সর্বসম্মত সংজ্ঞা না থাকায় ‘নতুন’ ও ‘অতিরিক্ত’ সহায়তাকে ঋণ হিসেবেও প্রদান করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রদত্ত মোট বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের ৭০ শতাংশই ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। জিসিএফ তহবিল প্রাপ্তিতে কঠিন মানদণ্ড নির্ধারণ করায় প্রয়োজনীয় জলবায়ু তহবিল পাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে তাপমাত্রা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির ফলে ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুত প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার এখন আর পর্যাপ্ত নয়, কেননা ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু তহবিলের চাহিদা প্রতিবছর ১৪০-৩০০ বিলিয়ন ডলার হবে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ক্রমবর্ধমান অভিযোজন ও প্রশমন চাহিদা মেটানোর জন্য অর্থায়নের নতুন সম্মিলিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণও জরুরি।

জলবায়ু অর্থায়নের প্রধান মাধ্যম জিসিএফএ অভিযোজন ও প্রশমন খাতে ৫০:৫০ অনুপাত বজায় রাখার কথা থাকলেও ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত বরাদ্দকৃত অর্থের হিসাবে এই অনুপাত ৩৮:৬২। জিসিএফসহ তহবিলের প্রকল্প অনুমোদন, অর্থ ছাড় ও কার্যক্রম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নে নীতিমালা ও জবাবদিহিতা নেই। বাংলাদেশে বাস্তবায়নরত একটি প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০১৫-২০২৪ সাল হলেও ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত এই প্রকল্পে অনুমোদিত মোট অর্থের মাত্র ৭ শতাংশ ছাড় করা হয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়নের নামে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক প্রকল্পে অর্থায়ন অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশে জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে আর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। বৈশ্বিক ও জাতীয় উদ্বেগ উপেক্ষা করে, ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার ভিত্তিতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়াই সুন্দরবনের মতো পরিবেশ সংবেদনশীল বনের কাছে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প স্থাপন করা হচ্ছে।

উন্নত দেশেগুলো প্রশমনসহায়ক প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তর তরান্বিত করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমাতে সম্মত হলেও বাস্তব চিত্র উল্টো, বরং ২০৩০ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার ১১০ ভাগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

বাংলাদেশও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ বন্ধের ঘোষণা দেয়নি। চলমান ও প্রস্তাবিত কয়লা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১১৫ মিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমানো সংক্রান্ত সরকারের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সাথে সাংঘর্ষিক।

অন্যদিকে ইনটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস (আইএনডিসিএস) বাস্তবায়নে ২০১৮ সালে প্যারিস রুলবুক বা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নির্দেশিকা গৃহীত হলেও এনহ্যান্সড ট্রান্সপারেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক এর আওতায় প্রতিবেদন প্রস্তুতিতে কিছু শর্ত শিথিল রাখা হয়েছে। এর ফলে প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। উন্নত দেশসমূহের বিবিধ বাধার মুখে (ক্ষয়-ক্ষতির বিষয় সরাসরি অস্বীকার করা, এজেন্ডা থেকে ক্ষয়-ক্ষতিবিষয়ক আলোচনা বাদ দেওয়া, সিদ্ধান্তসংক্রান্ত নথিতে ভাষাগত পরিবর্তন করা) ‘ক্ষয়-ক্ষতি’ মোকাবিলায় গত ৩০ বছরেও আলাদা কোনো তহবিল গঠন করা হয়নি।

লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়টি কপ২৭ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক আলোচনার এজেন্ডায়ও অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া, অনুদানভিত্তিক ক্ষতিপূরণ প্রদান না করে উন্নত দেশগুলো বিমা কার্যকর করায় গুরুত্ব দিচ্ছে, যা ক্ষতিগ্রস্তদের বিমার বোঝাসহ দুর্ভোগ আরও বাড়বে বলে মনে করছে টিআইবি।

এ প্রেক্ষিতে আসন্ন কপ২৭ সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতিসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতসহ প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য টিআইবি ‘বাংলাদেশ কর্তৃক কপ২৭ সম্মেলনে উত্থাপনযোগ্য’ ও ‘বাংলাদেশ সরকারের করণীয়’ দুইভাগে মোট ১৬টি দাবি পেশ করেছে।

টিআইবির উল্লেখযোগ্য দাবি হচ্ছে: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে উন্নত দেশগুলোকে ২০২০-২০২৫ মেয়াদের প্রতিশ্রুত মোট ৬০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানে একটি সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ প্রস্তুতে সমন্বিত দাবি উত্থাপন করতে হবে; জিসিএফসহ জলবায়ু তহবিলে ঋণ নয়, অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করতে হবে; ক্ষয়-ক্ষতিবিষয়ক আলাদা তহবিল গঠন করতে হবে এবং ঝুঁকি বিনিময়ে বিমার পরিবর্তে অনুদানভিত্তিক অর্থ প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের করণীয়: ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসূত অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জসমূহের ওপর প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে হবে; জীবন-জীবিকা, বন ও পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে স্থগিত করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ কৌশলগত পরিবেশের প্রভাব নিরূপণ সাপেক্ষে অগ্রসর হতে হবে; একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপসহ প্রস্তাবিত ইন্ট্রিগ্রেটেড এনার্জি এন্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান-আইইপিএমপিতে কৌশলগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিতে হবে; বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধিতে এ খাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সংক্রান্ত সকল প্রকল্পে সুশাসন, শুদ্ধাচার ও বিশেষত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০২২
এসএমএকে/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।