ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়া

জাতির পিতার ম্যুরালের পর্দাকাণ্ডসহ অধ্যক্ষের মহাদুর্নীতি

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২২
জাতির পিতার ম্যুরালের পর্দাকাণ্ডসহ অধ্যক্ষের মহাদুর্নীতি

ঢাকা: রাজধানীর পল্লবীর সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ। স্থানীয়রা বলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়া।

রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার চর্চা, জিম্মি করে রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। অধ্যক্ষ জহুরুল আলমের বিরুদ্ধেও রয়েছে অগণিত অভিযোগ।

শিক্ষক-কমীচারী, শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ চিন্তিত। বিষয়টি নিয়ে তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বরাবর আর্জি জানান। তিনিও বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর চিঠি দেন।

অধ্যক্ষ জহুরুল আলম কৃত নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সংস্করণের মধ্যে গুরুতর একটি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালের ফলক ঢেকে রাখতে কেনা পর্দা নিয়ে। লাল বর্ণের পর্দাটি কিনতে তিনি ব্যয় করেছেন ২০ হাজার টাকা। ম্যুরালটিও উদ্বোধন-উন্মোচন করেছেন চারবার। পকেটে ঢুকিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।

বাংলানিউজের একটি অনুসন্ধানে জহুরুল আলমের বহু দুর্নীতির তালিকা প্রতীয়মান হয়। যার মধ্যে রয়েছে- শিক্ষার্থী ভর্তি, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ইউনিফর্ম, ধর্মীয় উৎসব, বিভিন্ন জাতীয় দিবস, মুজিব শতবর্ষ, মাঠ সংস্কার, জঙ্গল পরিষ্কার, পুরনো ভবন বিক্রি, বৃক্ষ রোপণ। ছোট-খাটো আরও অনিয়ম তিনি করে থাকেন সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে। এ জন্য নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন একটি চক্র। সেই চক্রের কাছে জিম্মি জাতির পিতার নামে করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিযোগ, অধ্যক্ষ ও তার চক্র বিভিন্ন কাজের নামে ভুয়া বিল ভাউচারে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিনি ও তার দোসররা যে অনিয়ম-দুর্নীতি করে যাচ্ছেন, তার পরিণাম যেকোনো সময় হতে পারে ভয়াবহ।

তারা জানান, দেশ মাতৃকার জন্য যিনি নিজের সারা জীবন ব্যয় করেছেন কোনো দ্বিধা ছাড়া, যার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো, যাকে একাত্তরের বিরোধী বাহিনী হত্যা করলো- সেই জাতির পিতার ম্যুরালের পর্দা বানাতেও ‘চোরামি’ কীভাবে করতে পারেন অধ্যক্ষ জহুরুল আলম।

জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ম্যুরালের ফলক উন্মোচনের আয়োজন করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ জন্য অনুষ্ঠান করা হয়। ম্যুরালে লাল বর্ণের একটি পর্দা ব্যবহার করা হয়। এ পর্দা তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। অথচ এ পর্দার দাম হতে পারে সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা।

মায়ের দোয়া ক্লথ ষ্টোর নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পর্দাটি কেনা হয়েছে বলে দাবি অধ্যক্ষের চক্রের। ভুয়া বিল ভাউচার জমা দিয়ে পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেছে তারা। এ ছাড়া এক ম্যুরাল চার উন্মোচন দেখিয়ে মনগড়া বিল-ভাউচারে প্রায় দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা।

ওই অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ছিলেন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মাছুমা জাহান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রথমে কেনাকাটার কথা তিনি অস্বীকার করেন। কিন্তু ভাউচারে তার স্বাক্ষর রয়েছে জানালে তিনি বাংলানিউজের প্রতিবেদকের কাছে উল্টো কলেজের ভাউচার কীভাবে পেলেন জানতে চান। পরে তাকে অধ্যক্ষের রুমে ডাকেন ‘কথা বলার’ জন্য।

মায়ের দোয়া ক্লথ ষ্টোরটি মিরপুর ১১ নম্বরে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে গিয়ে পর্দার ব্যাপারে কথা হলে প্রতিষ্ঠানের মালিক আনিছুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমার দোকানে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা গজ দরে পর্দা বিক্রি হয় সে হিসেবে ওই পর্দার দাম সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা। ভাউচারটি আমার দোকানের হলেও কলেজে আমি কোনো পর্দা সরবরাহ করিনি।

চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল কলেজের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে হামলা ও তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি দেন অধ্যক্ষ ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেছেন ভুক্তভোগী।

গত ১৩ জুন কলেজের খেলার মাঠ সংস্কারের জন্য ১ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান দেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। মিরপুর ১২ নম্বরের ‘মা মমতাজ স্টিল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ভাউচার জমা দিয়ে পুরো অর্থ আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ জহুরুল আলম। মমতাজ স্টিলের প্রোপাইটর স্বপন ভূঁইয়াকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ভাউচার আমার প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু কোনো মালামাল আমি বিক্রি করিনি।

সরকারি কোনো আর্থিক নীতিমালা অনুসরণ না করে সুবিধাভোগী কিছু শিক্ষকদের দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগও রয়েছে জহুরুলের বিরুদ্ধে। আর্থিক স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের মাধ্যমে তাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। ২০১৮ সালে সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের পর থেকে জহুরুলের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বদলে গেছে রাতারাতি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানান, অধ্যক্ষ জহুরুল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কথা বলেন। নিজেকে একজন আদর্শবাদী অধ্যক্ষ হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু তার কথা-কাজে মিল নেই। প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় অধ্যক্ষের সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা এবং অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় ৫ হাজার টাকা নেওয়ার নিয়ম আছে। তিনি এ থেকে অল্প কিছু টাকা শিক্ষকদের দিয়ে বাকিটা নিজের পকেটে পোরেন। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে এসিআর’র ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখা হয়।

কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারী জানান, চায়ের কাপ-পিরিচ থেকে শুরু করে কোদাল, হাতুড়ি, করাত, শাবলসহ ক্রোকারিজ আইটেমের টাকাও যাবতীয় টাকা মেরে দেন অধ্যক্ষ। এ জন্য তিনি পিয়ন ও আয়াদের কাছ থেকে জোর করে খালি ভাউচারে স্বাক্ষর নেন। ভুয়া বিল ভাউচারসহ ভর্তি সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ রয়েছে বাংলানিউজের হাতে।

বিভিন্ন সময়ে কলেজে বৃক্ষ রোপণ করা হয়। ২০ হাজার টাকায় গাছ কেনা দেখানো হলেও মাত্র ১০-১২টি লাগিয়েছেন অধ্যক্ষ। তিনি ও তার চক্রের সদস্য সহযোগী শিক্ষকরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে এমন শিক্ষক-কর্মচারীদের দমিয়ে রাখতে শো-কজ, বরখাস্ত ও বেতন বন্ধের মতো ঘটনা ঘটান প্রতিনিয়ত।

কলেজের তহবিল তসরুপসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় অধ্যক্ষের দুর্নীতি পদে পদে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবকালীন ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ ছিল কলেজ। এ সময়ে প্রতিমাসে আপ্যায়ন ও জ্বালানি তেল বাবদ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করে জহুরুল। কলেজের মাইক্রোবাস সিএনজিতে রূপান্তরিত হলেও প্রতিমাসে জ্বালানি তেল বাবদ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। কলেজের এ বাহনটি তিনি তার পারিবারিক কাজেও ব্যবহার করেন।

বঙ্গবন্ধু কলেজের প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলার ছাদের টিন-শেড ঘর বিনা টেন্ডারে বিক্রি, আসবাবপত্র মেরামত ও সংরক্ষণের নামে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অংকের কমিশন  এবং ফলজ ও বনজ গাছ কেটে বিক্রির প্রমাণও আছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।

বোর্ডের নির্দেশ অমান্য করে ২০২২ সালের এইচএসসি ১ম বর্ষের টিসিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পুনঃভর্তি বাবদ ৩৫০০ টাকা; ডিগ্রি (পাস কোর্স), প্রাইভেট ও অনার্সের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তি ও রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ অতিরিক্ত এক থেকে দেড় হাজার টাকা আদায় করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

২০২০ সালের ডিগ্রির প্রাইভেটের এক শিক্ষার্থী জানান, ভর্তি বাবদ তার কাছ থেকে ১৫০০ টাকা নেওয়া হলেও কলেজ থেকে ৭৩৫ টাকার রিসিট দেওয়া হয়েছে।
ভর্তি বাতিলের ভয়ে অনেকে এ নিয়ে প্রতিবাদ করেনি।

এ ব্যাপারে কলেজের সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক মোদাচ্ছের বলেন, ডিগ্রির শিক্ষার্থীদের যে টাকার রিসিটি (৭৬৫ টাকা) দেওয়া হয়নি তা কলেজে এন্ট্রি আছে। এন্ট্রি দেখতে তিনি প্রতিবেদককে কলেজেও ডাকেন।

২০২০ সালের জুনে অধ্যক্ষ জহুরুলের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। জানা গেছে, অভিযোগ তদন্তে দায়িত্ব পেয়েছিলেন সরকারি বাংলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ফেরদৌসী খান। সেই তদন্তের প্রভাব খাটান জহুরুল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, জহুরুল এক সময় সরকারি বাংলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। সে সময় প্রফেসর ড. ফেরদৌসী খানের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে নিজের বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটান জহুরুল। ফলে ওই তদন্ত বেশিদূর যায়নি।

কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিয়েও প্রভাব খাটান অধ্যক্ষ জহুরুল। জানা গেছে, চলতি বছর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কলেজে ঢুকতে বাঁধা দেন অধ্যক্ষ জহুরুল। এ ঘটনায় গত ১৫ মার্চ কলেজের সামনে এক ফেসবুক লাইভে তার বিভিন্ন অপকর্মের কথা তুলে ধরেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাব্বি ও সংগঠনের অন্য নেতারা। এ সময় তারা অধ্যক্ষের দুর্নীতি, ভর্তির অতিরিক্ত টাকা আদায়, ইউনিফর্ম বাণিজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতার সমালোচনা করে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

সার্বিক পরিস্থিতিতে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে শিক্ষক-কমীচারী, শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অভিযোগ দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহকে। তিনি অধ্যক্ষের বিভিন্ন অপকর্ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি জহুরুল আলমের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কলেজের তহবিল তসরুপ, ভুয়া বিল ভাউচার জমা দিয়ে টাকা উত্তোলন, শিক্ষক-শিক্ষক সম্পর্কে ফাটল, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের অবনতি, শিক্ষার পরিবেশ ও শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গ, শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিতকরণ, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন ভাতা বন্ধের হুমকি, জামাত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতা ও ছাত্রলীগের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার অভিযোগ উল্লেখ করেছেন।

বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) এসব বিষয়ে কথা বলতে অধ্যক্ষ জহুরুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তার মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২২
এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।