সরকার দেশের ভূমি ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ও আমজনতার (সাধারণ মানুষের) হয়রানি লাঘবের জন্য অনেকগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পুরোনো ধ্যানধারণা ও উপরি প্রাপ্তির লোভ পরিত্যাগ করতে না পারায় অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ভালো উদ্যোগগুলো মাঠে মারা যাচ্ছে।
আমি নিজের একটি অভিজ্ঞতা সকলকে জানানোর জন্য এই লেখার প্রয়াস। আমার এক স্বজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী। কিছু দিনের জন্য তিনি দেশে এসেছেন। পৌরসভার এলাকার ভেতরে তার একাধিক খণ্ড ভূমি রয়েছে। তার একখণ্ড ভূমি পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পেয়েছেন। সেই ভূমির নতুন জরিপের মাধ্যমে সৃজনকৃত আর এস খতিয়ানের মুদ্রিত পর্যায় তার নাম ভুল ভাবে ছাপা হয়েছে। এই ভুল ভাবে মুদ্রিত নাম সংশোধনের উপায় কি সেটা তিনি ভূমি অফিস থেকে ঠিকঠাক ভাবে জেনে নিয়ে যথারীতি ২০ টাকার কোর্ট ফি দিয়ে উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর আবেদন (মিস কেইস) করেন।
আবেদনের সঙ্গে দেওয়া হয় তার বাংলাদেশি এনআইডির ফটোকপি, নাম ভুল হওয়া পর্চার কপি, ভুল নামের ব্যক্তি যে আবেদনকারীই (একই ব্যক্তি) সেই সত্যতা নিশ্চিত করা পৌর মেয়রের প্রত্যয়নপত্র।
উপজেলা ভূমি অফিস আবেদন গ্রহণ করে মিস কেইস নম্বর দিয়ে সেটি তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে পাঠান সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার (তহশিল) অফিসে। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাগজপত্র যাচাই ও সরজমিন তদন্ত করে উপজেলা ভূমি অফিসে রিপোর্ট পাঠান।
আমার সেই স্বজনের অনুরোধে আমি আবেদনটি কোন পর্যায়ে আছে, সেটা জানার জন্য ভূমি অফিসে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, আপনি ওনার উত্তরাধিকার সনদ দেননি। এটা দিতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে জরিপ চলাকালীন মাঠ পর্চা।
প্রবাস ফেরত আমার স্বজনকে মোবাইলে এই বিষয়টি জানালে তিনি জবাব দেন, এইসবের কিছুই তো আমার কাছে নাই। তিনি বলেন, বাবা মারা গেছেন ৩৩ বছর আগে, তার মৃত্যুর পর আমরা কোনো উত্তরাধিকার সনদ নিয়েছিলাম কি না সেটা তো মনে পড়ছে না। আমি তখন লন্ডনেই ছিলাম। আর জরিপ চলাকালে ছোটভাই নাম উঠিয়েছে, সে কি এই ভুল করেছে, না দেশের ভূমি বিভাগের জরিপকারীরা ভুল করেছে সেটা তো তারা দেখবে। কাগজপত্র তো তাদের কাছে সংরক্ষিত থাকার কথা, আমি উত্তরাধিকার সনদ আর মাঠ পর্চা এখন কোথায় পাবো!
আমি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে আমার স্বজনের বক্তব্য জানালাম। তিনি বললেন, আমাদের কিছু করার নাই। ম্যাডামের সামনে ফাইল দিতে হলে এই কাগজগুলো আপনাকে সংগ্রহ করে দিতে হবে। এইসব কাগজ ছাড়া ফাইল ম্যাডামের সামনে দিলে তিনি রাগ করেন। অতীতে এরকম হয়েছে, তাই কষ্ট করে হলেও কাগজগুলো সংগ্রহ করে আনুন। তিনি ইউনিয়ন অফিস থেকে উত্তরাধিকার সনদ পাওয়ার পথও বাতলে দিলেন।
সেই স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলাম তাদের গ্রামের বাড়ির কাছের ইউনিয়ন অফিসে। পেয়ে গেলাম ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে। বিশদ জানালাম। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান উত্তরাধিকার সনদ পাওয়ার আবেদন ফরম এগিয়ে দিলেন। ফরমপূরণ করার পর ইউনিয়ন কর পরিশোধের খাতা বের করে চেয়ারম্যান জানালেন, ওনাদের তো অনেক বছরের কর পরিশোধ করা নাই। তিনি হিসাব কষে একটা অঙ্ক কর চাইলেন। সেটা পরিশোধ করা হলো। এখন সংশ্লিষ্ট মেম্বারের জন্য অপেক্ষা। মেম্বার সাহেব এসে তাকে শনাক্ত করে প্রতিবেদন লিখে দিতে হবে। চেয়ারম্যান সাহেব কয়েকবার মেম্বারকে মোবাইলে কল করলেন। অনেকক্ষণ পরে মেম্বার সাহেব এলেন। তিনি প্রতিবেদন লিখে দিলেন। তারপর ইস্যু হলো উত্তরাধিকার সনদ।
আমরা গাড়ি নিয়ে ছুটে এলাম আবার ভূমি অফিসে। অফিস সময় তখন শেষ হওয়ার পথে। তাড়াহুড়ো করে উত্তরাধিকার সনদের ফটোকপি সংশ্লিষ্ট ক্লার্ককে বুঝিয়ে দিলাম। এখন বাকি থাকলো মাঠ পর্চা। মাঠ পর্চা সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য ওই অফিসেরই একজন এগিয়ে এলেন; তিনি দায়িত্ব নিলেন মাঠ পর্চা সংগ্রহ করার। বিনা খরচায় মাঠ পর্চা পাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। এখন সংশ্লিষ্ট ক্লার্ক জানালেন, মাঠ পর্চা পাওয়া পর সার্ভেয়ার সাহেব রিপোর্ট দেবেন। আপনি তিন দিন পরে বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে এসে খবর নিন।
আমি তিনদিন পরে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই গেলাম উপজেলা ভূমি অফিসে। সংশ্লিষ্ট ক্লার্ক নেই। খবর নিলাম। অফিসের লোকজন জানালেন, ম্যাডামের সঙ্গে মোবাইল কোর্টে গেছেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে ভূমি অফিসের ওয়েবসাইটে গিয়ে সেই ক্লার্কের মোবাইল নম্বর নিয়ে কল দিলাম। তিনি ধরলেন না। পরে একটি খুদে বার্তা পাঠিয়ে আমি সেই স্বজনের বাসায় গিয়ে আরও কিছু সময় কাটিয়ে বেলা ১টায় আবার ভূমি অফিসে গেলাম। সংশ্লিষ্ট ক্লার্ককে পেয়ে খবর নিলাম, কি অবস্থা ওই ক্লার্ক আমাকে বললেন, আপনি স্যারের (ম্যাডাম) সঙ্গে একটু দেখা করে নিন। স্যার ডাকলে আমি ফাইল নিয়ে যাবো।
আমি দেখা করে বিষয়টি জানালাম। তিনি ক্লার্ককে ডেকে ফাইল আনালেন। সকল কাগজপত্র ভালো করে দেখলেন। বললেন, তিন শব্দের নামের শেষ শব্দে পিতার পদবির সঙ্গে আবেদনকারীর পদবি মিল আছে। কিন্তু নামের আদ্যক্ষর ছা এর ¯লে খ হয় কীভাবে আবার দেখছি মধ্য শব্দের মিয়াটাও রহমান হয়েছে। এটাতো অনেক বড় ভুল। ক্লার্কের কাছে জানতে চাইলেন; তদন্ত করা হয়েছে কি ক্লার্ক বললেন, তহশিলদার ও সার্ভেয়ারের রিপোর্টের কথা। আমি বললাম, এনআইডি ও পাসপোর্টে যে নাম আছে সেটাই ওনার সঠিক নাম। তার পাসপোর্টসহ এই দেশে আরও যেসব ভূসম্পত্তি আছে সেগুলোর কাগজপত্রেও এই নাম।
আমার কথা আমলে নিলেন কী নিলেন না ঠিক বুঝলাম না।
তিনি ওই ফাইলে কী যেন লিখতে লাগলেন। লেখা শেষ হওয়ার পর ফাইলটি ক্লার্কের হাতে দিলেন। সেই ক্লার্ক ফাইল নিয়ে সার্ভেয়ারের রুমে এসে ঢুকলেন। আমিও পেছন পেছন এলাম। মনে করেছিলাম হয়ত কাজ শেষ হলো।
কিন্তু সার্ভেয়ার জানালেন, আবার আমাকে তদন্তের জন্য লিখে দিয়েছেন। সার্ভেয়ার আমার মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, আমিতো তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলামই। আবার আমি কী তদন্ত করবো আমাদের কাজকামই এইরকম জনাব, অপেক্ষা করুন!
অফিসে থেকেই আমার স্বজনকে জানালাম, আজ আপনার কাজ শেষ হয়নি। এসিল্যান্ড আবার তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এখন তদন্ত করে দেখবে আপনি সঠিক ব্যক্তি কি না। তারপর আপনার নাম সংশোধন হতেও পারে-নাও হতে পারে। আমি সার্ভেয়ারকে বললাম, আপনি তদন্ত করে রিপোর্টটা তাড়াতাড়ি দেবেন আশা করি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন।
অফিসের বারান্দা থেকে যখন নামছিলাম তখন একজন পেছন থেকে আমাকে ডাকলেন। আমার সঙ্গে পথ হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইলেন, মিস কেইসটা কি আপনারা নিজে করেছেন আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, পয়সা বাঁচানোর জন্য করেছেন তো, এজন্য আরও অনেকদিন আপনাদের ঘুরতে হবে। তাদের নির্ধারিত লোকের মাধ্যমে (দরদাম ঠিক করে) মিস কেইস করলে আজই কাজ হয়ে যেত। তবে আপনার খরচাপাতি কিছুটা বেশি লাগতো।
অভিজ্ঞতার বিষয়টি নিয়ে আদ্যোপান্ত লম্বা বয়ান লেখাটা কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নয়। লেখার কারণটা হচ্ছে, ভূমি বিভাগের দুই-দুজন কর্মকর্তা তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার পর আবারও তদন্ত! কেবল কী আমাদের উপজেলা ভূমি অফিসেই এমন হয়রানি মূলক ঘটনা ঘটছে? নিশ্চয় না।
ভূমি অফিসে কর্মরত একজন অন্য আরেকটি উপজেলা ভূমি অফিসের নাম উল্লেখ করে আমাকে জানালেন, ওই অফিসে কারণে অকারণে সেবা প্রত্যাশীদের হয়রানি করা হচ্ছে। এভাবে হয়ত দেশের অনেক উপজেলাই এমন হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটছে, যা সরকারের ওপর মহল জানছে না। এর ফলে তো সরকারের ভূমিবিষয়ক ভালো ভালো পদেক্ষেপগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ করে স্মার্ট বাংলাদেশ করার পথে এগোচ্ছি। কিন্তু এখনো ভূমি অফিসের এই নাম সংশোধন আবেদন (মিস কেইস) মান্ধাতার আমলের মতো রয়ে গেছে! এটাকে কেন ই-সেবার আওতায় অনলাইন করতে পারলাম না কেন এমন একটি কাজের জন্য সেবা প্রত্যাশীকে চার-পাঁচদিন ইউনিয়ন ভূমি অফিস কিংবা উপজেলা ভূমি অফিসে আসা-যাওয়া করতে হবে?
এই হয়রানিমূলক অবস্থা রেখে কি আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে পারবো?
আবেদনের সঙ্গে এতসব কাগজপত্র নেওয়ার পরও যদি কর্মকর্তা বিশ্বাস করতে না-ই পারলেন, তবে তো মেয়র কিংবা চেয়ারম্যানের মতো জন প্রতিনিধিদের দেওয়া প্রত্যয়নপত্র ও উত্তরাধিকার সনদের কোনো মূল্যই থাকলো না। তারা এইসব কাজের জন্য প্রত্যয়নপত্র ও উত্তরাধিকার সনদ কেনই বা দেবেন তাদের দেওয়া সনদগুলো আমলে না নেওয়া কি তাদেরকে অপমান করা নয়!
তাই বলছি, ঊর্ধ্বতন মহল ভাবুন। সেবার বিষয়গুলো কীভাবে আরও সহজ করে আমজনতার হয়রানি কমানো যায়। একজন ব্যক্তির এনআইডিই তো তার (পিতা মাতার নামসহ) সকল পরিচয় বহন করে। নাম সংশোধনের জন্য তাকে প্রত্যয়নপত্র, উত্তরাধিকার সনদ, মাঠ পর্চা, পাসপোর্টের কপি এতো এতো কাগজ দিতে হবে কেন!
লেখক: আবদুল হামিদ মাহবুব-সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক, সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০২৩
এসআইএস