একুশ শতকে বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান (২০২৪) একটি মাইলফলক। চাকরিক্ষেত্রে কোটা সুবিধার যৌক্তিক সংস্কার, রাজনৈতিক অধিকার বাস্তবায়ন, বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং পরিশেষে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চলা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানোর জন্য ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আমাদের এই গণ-অভ্যুত্থান দাঁড়িয়ে আছে দুটি সাফল্য নিয়ে। প্রথমটি হলো গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অত্যাচারী ও আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকারের পতন হয়েছে। অন্য সফলতাটি হচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ সামাজিক বিষণ্নতা কাটিয়ে একটি নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে চাচ্ছে বহু কাঙ্ক্ষিত অন্তর্বর্তীক সরকারের মাধ্যমে। মূলত আন্দোলনের সূত্রপাত চাকরিক্ষেত্রে কোটা সুবিধার যৌক্তিক সংস্কার নিয়ে হলেও মানুষের মূল চাহিদা ছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন অর্থাৎ স্বৈরশাসনের অবসান।
মানুষের দীর্ঘদিনের হতাশা, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং গণতন্ত্রের দাবি একত্রিত হয়ে একটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে ইউনূস সরকারের উত্থান ঘটিয়েছে। তবে এই নতুন সরকারের সামনে বড় প্রশ্ন হলো—আদৌ কি তারা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে? আর আমরা, সাধারণ মানুষ, কিভাবে নিশ্চিত হব যে আবার নতুন করে স্বৈরাচারের উত্থান হবে না?
এই প্রশ্নে আমরা সবাই নতুন রাজনীতিতে আমাদের প্রত্যাশা রাখতে পারি। আমাদের প্রত্যাশা হবে এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে। পাঁচ বছর পর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনব্যবস্থা হবে স্বচ্ছ, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে।
প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমানভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে কিংবা অর্থনৈতিক শক্তির প্রভাবে বিচার বা প্রশাসনিক সুবিধা প্রদান বন্ধ করতে হবে। সরকারের প্রতিটি কাজের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার বিষয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্নীতি দমনে জিরো টলার্যান্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিটি দুর্নীতি তালিকাভুক্ত করে অতি সত্বর জাতির উদ্দেশে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
ক্ষমতার কাঠামোকে কেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হতে হবে, যাতে কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক সব শ্রেণির মানুষের জন্য সমান সুযোগ তৈরি হতে পারে।
আমার মতে, এত সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জনগণের আশা পূরণ করতে চাইলে ইউনূস সরকারকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে, অধিদপ্তরে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহাল তবিয়তে থাকা স্বৈরাচারের দোসর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। স্বৈরাচারী সরকারের সব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন কিংবা রদ করতে হবে, যাতে প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়—সব ক্ষেত্রে সত্য প্রকাশের জায়গা তৈরি হয়। মৌলিক সেবাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বেকারত্ব কমাতে হবে। অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং আমদানি-রপ্তানিতে চলা সিন্ডিকেট দূর করতে হবে। জুলাই আন্দোলনে গণহত্যা চালানো রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা ও ক্যাডারদের পাশাপাশি গণহত্যাকারীদের দোসর চিহ্নিত বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী, টেলিভিশন তারকা, খেলোয়াড় ও অন্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এত সব কাজের পরও এই সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে, কিভাবে তারা পূর্ববর্তী সরকারের মতো কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে না এবং নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে।
এ ক্ষেত্রে নতুন রাজনীতি বলি কিংবা ইউনূস সরকার বলি, উভয়ের সফলতার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমেই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক হুকুমের প্রভাবমুক্ত থাকে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নাগরিক সমাজের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা বাড়ানো এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ নির্ভয়ে তাদের চিন্তা ও অভিমত প্রকাশ করতে পারে। সবচেয়ে জরুরি হলো নির্বাচনী সংস্কার, অর্থাৎ নির্বাচনব্যবস্থাকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য করে তুলতে হবে।
এতক্ষণ তো সরকারের কী করা উচিত কিংবা আমাদের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা করা হলো। এখন নতুন শাসনব্যবস্থায় স্বৈরাচারের জন্ম রোধ করতে আমাদের সম্মিলিতভাবে কিভাবে সচেতন থাকতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আমাদের প্রতিটি নাগরিকের আদর্শ হতে হবে নিজ নিজ নাগরিক দায়িত্ব পালন। শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত প্রতিটি নাগরিককে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের মধ্যে সমালোচনামূলক দৃষ্টি ও সাহস রাখতে হবে। সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও শিক্ষিত জনগণকে সমালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আমাদের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের মতো অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মনোভাব রাখতে হবে। আবার যদি কখনো জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন হয় কিংবা নতুন স্বৈরাচার তৈরি হয় তাহলে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধ করতে হবে। এর পর থেকে সংবিধান সংস্কার করে ক্ষমতা একক ব্যক্তির হাতে না দিয়ে দল বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, জুলাই ২০২৪-এর গণ-আন্দোলন একটি নতুন ভোরের সূচনা করেছে। তবে এই নতুন দিনের আলো টিকিয়ে রাখা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। বিপ্লব-পরবর্তী ইউনূস সরকার যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে গণ-আন্দোলনের ত্যাগ ও চেতনা ম্লান হয়ে যাবে। একসঙ্গে কাজ করে এবং গণতন্ত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করেই কেবল আমরা একটি উন্নত ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবিচল থাকা ছাড়া বিকল্প নেই।
লেখক: দ্বিতীয় বর্ষ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)