ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজনীতির আসল শক্তি জনগণ

মোফাজ্জল করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৫
রাজনীতির আসল শক্তি জনগণ

রাজনীতি কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিন্তার জগতে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক শব্দ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। এগুলো একটি আরেকটির সহযাত্রী, কখনো বা পরিপূরক।

প্রথমেই আসে পারিপার্শ্বিক জগৎ, সেই জগতের মানুষ, গোষ্ঠী, দল, তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ইত্যাদির কথা। কেন? এই জন্য যে রাজনীতি কোনো এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাব্য-সাহিত্য রচনা নয়, নয় কোনো দার্শনিক চিন্তা বা কল্পনাবিলাস।

রাজনীতি মানুষের জন্য, তার চিন্তা-চেতনা, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবন-জগজ্জনিত তার হাজারো সমস্যাই রাজনীতির উপজীব্য এবং এ কারণেই রাজনীতি মানেই জনসম্পৃক্ততা।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ‘জন’টা কে? তিনি কি শুধু রাজনীতিবিদ সাহেব বা সাহেবার ভাই-বেরাদর, খয়ের খাঁ, ২৪ ঘণ্টা হাত-কচলানো মোসাহেব, কিংবা তাঁর দল বা গোষ্ঠীর সদস্য/সমর্থক। না, নিশ্চয়ই তা না। ওটা হলে তো তাঁর কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে সীমিত হয়ে পড়বে মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক লোকের মধ্যে।

তারা হতে পারে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্য। আবার না-ও হতে পারে। একজন রাজনীতিককে সম্পৃক্ত হতে হয় তাঁর এলাকা এবং বৃহত্তর পরিসরে এলাকা ছাড়িয়ে সমগ্র দেশের মানুষের ভাবনা-চিন্তা, সুখ-দুঃখ, সমস্যা-সম্ভাবনার সঙ্গে। এককথায়, একজন প্রকৃত রাজনীতিকের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই থাকবে তাঁর নিজ এলাকার মানুষ ও পারিপার্শ্বিক জগৎ।
কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতেও তাঁর ভূমিকা পালন করতে হতে পারে। অবশ্যই তিনি যদি নিজেকে কেবল নিজ এলাকার মানুষ ও তাদের সমস্যাদি নিয়েই ব্যস্ত রাখতে চান; যেমন—আমাদের দেশের ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা যদি শুধু নিজ এলাকায়ই নিজেকে সারা জীবন গুটিয়ে রাখতে চান, এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ, সমস্যা নিয়েই কাটিয়ে দিতে চান জীবন, তাহলে সেটাই হবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কর্মক্ষেত্র। এর বাইরে জেলায় বা রাজধানীতে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে তাঁর কোনো ভূমিকা পালন না করলেও কেউ উচ্চবাচ্য করবে না। তবে হ্যাঁ, যে পরিসরেই রাজনীতি করুন না কেন, আপনার নিজস্ব পরিমণ্ডলে যে মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের সঙ্গে আপনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন, যাদের ঝগড়া-ফ্যাসাদ, বিয়ে-শাদি থেকে শুরু করে মরণে-জিয়নে সব কিছুতে যারা আপনাকে ঘোষিত বা অঘোষিত নেতা বলে মানে, তাদের থেকে আপনি কিছুতেই দূরে থাকতে পারবেন না। আপনার ভালো লাগুক বা না-ই লাগুক, আপনি রাজনীতিক হলে অবশ্যই আপনাকে আপনার পারিপার্শ্বিক জগতের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকতে হবে।
তা না হয়ে যদি আপনি কেবল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির চর্চায় মশগুল থাকেন তাহলে আপনি হবেন আমাদের দেশের অগণিত অনুপস্থিত ভূস্বামীর (ইংরেজিতে যাদের বলা হয় ‘অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ড’) মতো, যাঁরা নিজের ক্ষেতে উৎপন্ন ফসলের ষোলো আনা নিতে চান, অথচ ওই জমি বা তার চাষিকে চেনেন না।


আপনি একটি এলাকার গণ্যমান্য রাজনীতিক, এলাকায় বংশমর্যাদা, শিক্ষাদীক্ষা, বিত্তবেসাত—সব ব্যাপারে আপনার একটা পরিচিতি আছে, স্থানীয় রাজনীতিতে এগুলো খুব কাজে লাগে, কিন্তু আপনি যেকোনো কারণেই হোক লোকজনের সঙ্গে তেমন একটা মেশেন না, আপদে-বিপদে তারা আপনাকে পাশে পায় না। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, যেমন—বিয়ে-শাদি, দাওয়াত-জিয়াফতও আপনি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন। এটা কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে একটা বড় রকমের মাইনাস পয়েন্ট। আপনার সম্পর্কে এলাকার মানুষ বলতে শুরু করবে, ‘ও, উনি? উনি বহুত এলেমদার লোক ঠিকই, তবে নাক উঁচু। উনি তো কাউকে মানুষই মনে করেন না। ’ 

আর এটা তো ঠিক, আপনি আপনার এলাকায় রাজনীতি করবেন, নেতৃত্ব দেবেন, অথচ এলাকাবাসীর সঙ্গে মিশবেন না, তাদের সমস্যা কী জানবেন না, জানলেও তার সমাধানের ব্যাপারে তাদের মতামত নেবেন না—এটা হয় নাকি? একটা রাস্তা বানানো হবে, সেটা কলিমদ্দির বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে, না সলিমদ্দির বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে সেটা এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে স্থির না করে স্থানীয় নেতা হিসেবে আপনি বা কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদে বাগড়ার সম্মুখীন হতে হবে। অথচ সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে সবাই মনে করবে, এটা আমাদের প্রজেক্ট। একে সফল করতেই হবে। এমন প্রজেক্ট যেটা ওপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে নিচে থেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রণয়ন করা হয় সেটাকেই বলা হয় ‘বটম আপ’ প্রজেক্ট। এর বিপরীতে ওপর থেকে যে প্রজেক্ট চাপিয়ে দেওয়া হয় তাকে বলে ‘টপ ডাউন’ প্রজেক্ট।

আমাদের নেতাদের মধ্যে প্রায়ই একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়, সেটা হচ্ছে ‘পরের মুখে ঝাল খাওয়া’। অর্থাৎ যেকোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের পছন্দসই চামচাদের পরামর্শমতো সিদ্ধান্ত নেওয়া। যেন এই চামচারাই জনগণ, তারাই সবজান্তা। তারা সারাক্ষণ নেতার পাশে ঘুরঘুর করে, সব কথায়ই পোঁ ধরে। এই টাউটগুলো যে নেতাকে ভাঙিয়ে টু পাইস কামাই করছে, নেতা এটা জেনেও না জানার ভান করেন। আবার কোনো কোনো নেতার সঙ্গে তাঁর টাউটদের দশ আনা ছয় আনার হিসাব-কিতাব থাকে। ফলে তৃণমূল পর্যায়েও দুর্নীতি তার জাল বিস্তার করে চলে।  

প্রকৃত নেতাকে হতে হবে উচ্চ-নীচ, ধনী-গরিব, নিজ দল, বিরোধী দল—সবার নেতা। হ্যাঁ, আদর্শগতভাবে বিরোধী দলের জনগণের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তাই বলে তাদের সঙ্গে সাধারণ সৌজন্যমূলক আচার-আচরণ বর্জন করলে তিনি আর যা-ই হোক জননেতা হতে পারবেন না। এলাকার সমস্যাদি দূর করার কাজে আপন-পর সব এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করা একজন প্রকৃত উদারচিত্ত নেতার লক্ষণ। তেমনি সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজে দল-মত-নির্বিশেষে এলাকাবাসী সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যথায় ভালো কাজ করেও অনেক সময় মিছেমিছি সমালোচনা ও অহেতুক অপবাদের সম্মুখীন হতে হয়।

জনসম্পৃক্ততা না থাকলে নেতা-নেত্রীদের পরিণতি কী হয় তা আমরা জুলাই-আগস্ট ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেখেছি। তখনকার স্বৈরাচারী শাসকদের ধারণা ছিল, তাঁরা যা বলবেন বা করবেন তা দেশের আপামর জনসাধারণ চোখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য। এ রকম ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁরা তাঁদের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী দলকানা নেতা-নেত্রী ছাড়া অন্য সবার, বিশেষ করে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়েছিলেন দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে। অবশেষে যখন সচেতন ছাত্রসমাজের ডাকে সাধারণ মানুষ তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল তখন তাঁরা লোটা-কম্বল ফেলে ভাগলেন। ওই সময় তাঁদের একমাত্র আপ্তবাক্য ছিল, ‘য পলায়তি, স জীবতি। ’ গ্রামের লোকের ভাষায়, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ’ অথচ যদি তাঁরা শুধু নিজেদের চ্যালা-চামুণ্ডাদের নিয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত না থেকে, দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড়-পর্বত বানাতে যত প্রকার দুর্নীতি আছে তাতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত না হয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতেন, তাহলে হেলিকপ্টারে চড়ে পগার পার হতে হতো না। ওই সাধারণ মানুষই তাঁদের রক্ষা করার জন্য ছুটে আসত। আফসোসের বিষয়, দীর্ঘ দেড় যুগ তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন থাকায় রাজনীতির আসল শক্তি যে জনগণ, সেই জনগণ থেকেই তাঁরা দূরে চলে গিয়েছিলেন।

দেশবাসীর এখন একটাই প্রার্থনা, দেশে যথাশীঘ্র সম্ভব একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক, যার ভিত্তি স্থাপিত হবে তাদের স্বপ্নের একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আর তা পেতে হলে সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা জাতীয় ঐক্য, যে ঐক্য হবে সব ধরনের অপশক্তির বিরুদ্ধে।

এটা ঠিক, ‘দেশটাকে এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’ বলে যারা আবারও মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার পাঁয়তারা করছে, তারা দেশি-বিদেশি সব কুচক্রীর সহায়তায় একটা মরণকামড় দেবেই। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, তাদের এত বড় অন্যায় ১৭ কোটি মানুষ আর সহ্য করবে না। একবার যখন জনতার ঘুম ভেঙেছে, তখন তারা নিজেদের বাসস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিত না করে শয্যামুখো হবে না। তাদের জন্য এখন বাণী একটাই, তোমাদের আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ‘যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে’। (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

লেখক: সাবেক সচিব, কবি

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।