দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে নিপীড়ন-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। ২০১৭ সালের আগস্টে এই নিপীড়ন মারাত্মক আকার নেয়।
মিয়ানমারে ২০১৫ সালের সংসদ নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় পেলেও স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারছিল না আগের সেনা সরকার প্রণীত ২০০৮ সালের সংবিধানের কারণে। ওই সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সংসদের অন্তত ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকবে। সামরিক বাহিনীর সদস্যের সম্মতি ছাড়া সংবিধানের ধারা ও আইন পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। এরপরও ২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি পুনরায় জয়ী হয়। কিন্তু দেশটির সামরিক বাহিনী নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পুনরায় সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয়। সারাদেশে শুরু হয় হাজার হাজার গণতন্ত্রকামী মানুষকে গ্রেপ্তার-নির্যাতন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, গত তিন বছরে রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাতে মিয়ানমারের ২৬ লাখ মানুষ শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। এই সময়টাতে সেখানকার অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বাড়ছে ক্ষোভ। ক্ষমতায় আসার তিন বছর পর মিয়ানমারের জান্তা সরকার এখন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায়।
অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ২০২১ সালের এপ্রিলে এনএলডির নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার ‘এনইউজি’ গঠন করে। সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা প্রশিক্ষণ নেয় এবং সব জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন করে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’। তারপর দেশটির বিভিন্ন জায়গায় জান্তার অনুগত বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াইয়ের খবর আসতে থাকে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে শান রাজ্যের সংখ্যালঘু তিনটি বাহিনী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) একত্রিত হয়ে ‘থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স’ গঠন করে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। তারা এই যুদ্ধের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭’। এছাড়াও নির্যাতিত-নিপীড়িত অনেক মানুষ এই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আরাকান আর্মি ১৩ নভেম্বর রাখাইনে অপারেশন শুরু করার পর পাউকতাও শহর এবং চিন প্রদেশের পালেতাওয়া শহরসহ ১৬০টি অবস্থান থেকে জান্তার বাহিনীকে উৎখাত করেছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করেছে।
বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারাও সেখানে ফেরত গিয়ে অংশ নিচ্ছে সেই যুদ্ধে। ক্যাম্পে থাকা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে বলে খবর রয়েছে। কেউ আবার মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ফেলে যাওয়া অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি এমন ২৩ জনকে বিজিবি কর্তৃক আটকের পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, জব্দ করা হয়েছে ১২টি অস্ত্র।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আড়াইশ’ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। জানুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বিজিপি পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে। এর আগে শত শত সৈন্য সীমান্ত দিয়ে চীন ও ভারতে পালিয়েছে। যুদ্ধে সামরিক টহল চৌকি, অস্ত্রাগার ও বেশ কিছু শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিদ্রোহীদের হাতে। নতুন করে হামলা শুরুর পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই সংকট গভীর হওয়ার কারণ, সামরিক বাহিনী কিংবা বিদ্রোহীদের কেউই শান্তি আলোচনায় বসতে রাজি নয়।
মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত ‘স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার’-এর তথ্য মতে, জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে ১৭ শতাংশ ভূখণ্ড, বিদ্রোহীদের দখলে ৫২ শতাংশ এবং ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড দখলে সংঘাত চলমান।
এদিকে ভূ-রাজনৈতিক কারণে চীন ও রাশিয়া সমর্থন দিচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে। তারা সেখানে পশ্চিমা শক্তির প্রবেশ ঠেকাতে চায়। মিয়ানমারের প্রান্তিক অঞ্চলজুড়ে আছে চীনের বিপুল বিনিয়োগ ও বাণিজ্য। আবার মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটিই একমাত্র দেশ, যেটি স্থলপথে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে ভৌগোলিকভাবে যুক্ত করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতেও ভারতের জাতীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ যুদ্ধ বাংলাদেশের নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গা সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। আরও খোলাসা করে বললে, রাখাইনসহ মিয়ানমারে সংঘাত প্রশমিত না হলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের সহযোগিতা কামনা করেছে বাংলাদেশ। সহযোগিতার জন্য ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছে দেশটি। তবে বাংলাদেশকেই ঠিক করতে হবে কৌশল ও করণীয় ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪
টিসি