ঢাকা, বুধবার, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাফুফের নির্বাচন এবং আমাদের প্রত্যাশা

ইকরামউজ্জমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০২৪
বাফুফের নির্বাচন এবং আমাদের প্রত্যাশা ইকরামউজ্জমান

ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সর্বত্রই আলোচনায় স্থান পাচ্ছে এখনই সময় চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়ে সংস্কার করার।

এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতিবাচক দিক হলো, এই বিষয়টিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এখন সুযোগ মনে করা হচ্ছে।

দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। এই খেলাটি বছরের পর বছর ধরে ধুঁকছে। আর কেন ধুঁকছে এটি সাধারণ মহলেরও অজানা নয়।

সবাই চাইছেন পেশাদারি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ফুটবল ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। খেলার প্রতি মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। ফুটবল জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথে টেকসইভাবে এগিয়ে যাবে।
দেশের ফুটবল হোক মানবিক।

এই চত্বরে প্রতিষ্ঠিত হোক বৈষম্যহীনতা এবং সক্ষমতা। এখনই সময় এই চত্বর থেকে অসংগতিগুলো সংশোধনের। নীতিগত সমন্বয়হীনতার জাল থেকে ফুটবল বেরিয়ে আসুক। ফুটবল চত্বরে অবসান হোক ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থের খেলা। এই চত্বরে একত্ববাদিতা বা একনায়কতন্ত্র নয়, সবাইকে সংযুক্ত করে ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হবে।

ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেন, করতে চান তার প্রমাণ তো ফুটবলে আছে।
মানুষ চাইছে ফুটবল শুধু ঢাকা এবং বড় বড় শহরে নয়, দেশজুড়ে আগের মতো মাঠে মাঠে গড়াক। ফুটবল হোক সবার নির্মল বিনোদনের মাধ্যম। চিন্তা-ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব ফুটবলকে জাগিয়ে তোলা। ফুটবল এখনো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। যেকোনো খেলায় ঘরোয়া আসরে খেলা চত্বরে যত বেশি মানুষের সমাগম হয়, এর চেয়ে অনেক বেশি হয় ফুটবলে!

দেশে ফুটবল চলছে লক্ষ্যহীনভাবে। দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি, শৃঙ্খলা এবং সুশাসনের ক্ষেত্রে রয়েছে প্রচণ্ড ঘাটতি। সনাতনি ফুটবল সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে ফুটবল পারবে না জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে। ফুটবল তো শুধু একটি খেলা নয়, একটি লাভজনক শিল্পও। যেকোনো ট্র্যাডিশনাল অর্থনৈতিক প্রকল্পের চেয়ে এই শিল্পটি অনেক বেশি লাভজনক। ৫৩ বছরেও ফুটবলকে বিপণন করা সম্ভব হয়নি। এটি একটি ব্যর্থতা। এর জন্য প্রয়োজন পেশাদারি মনোভাবসম্পন্ন, মুক্তচিন্তার অধিকারী ফুটবল সংগঠক, যাঁরা মতৈক্যে পৌঁছে তাঁদের প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করবেন। ফুটবলকে যখন বিপণন করা সম্ভব, তখন এই চত্বরের ৭০ শতাংশ প্রতিবন্ধকতা আর থাকবে না।

দেশের ফুটবলের রুগ্ণ চেহারা। এর জন্য যে শুধু ফুটবল সংগঠকরা দায়ী, তা কিন্তু নয়, দায়ী ক্লাব কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, কোচ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যরাও। বাফুফের গভর্নিং বডি তো ২১ সদস্যবিশিষ্ট। শুধু এই ২১ জনের কর্মকাণ্ডে তো ফুটবল আলোর মুখ দেখবে না। দেশের ফুটবল উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সব মহলের আন্তরিকতা এবং সহযোগিতা।

ফুটবল সংগঠকদের মধ্যে অন্তঃকলহ, বিভিন্ন ধরনের মতপার্থক্য এবং বিবাদ আছে। এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেটি প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে জাতীয় স্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে একমত হওয়া। দেশের ফুটবল প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা থেকে হরহামেশাই বঞ্চিত হচ্ছে। ফুটবল মাঠে শুধু দলীয় খেলা নয়, ফুটবলের ভালো প্রশাসনও এর ব্যতিক্রম নেই। স্ববিরোধিতা এবং আদর্শগত শূন্যতা দেশের ফুটবলের ক্ষেত্রে বড় একটি চ্যালেঞ্জ!

বাফুফের নির্বাচন এবং আমাদের প্রত্যাশাঘরোয়া ফুটবলে দু-একটি ছাড়া ক্লাবগুলোর চেহারা হতদরিদ্র। ভালো দল গঠনের পাশাপাশি যদি ক্লাবগুলো আধুনিক করার, ভালো পরিবেশ সৃষ্টির দিকে নজর দিত, তাহলে সমর্থক এবং ভক্তরা আবার মাঠমুখী হতো। ক্লাবের সান্নিধ্য চাইত। এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বসুন্ধরা গ্রুপের ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। তারা প্রথম থেকেই দেশি-বিদেশি সেরা খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠনের পাশাপাশি ক্লাবের পরিবেশ, ফুটবল কার্যকলাপে আধুনিকায়ন, ফুটবলে বিজ্ঞানের ব্যবহার, খেলার মাঠ এবং একটি পর্যায়ে এসে আধুনিক নিজস্ব অ্যারেনা নির্মাণ করেছে। এই অ্যারেনা এএফসি এবং ফিফা অনুমোদিত। নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে দেশের ফুটবল উন্নয়নে সর্বাত্মকভাবে পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য। বসুন্ধরা গ্রুপ সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে শুধু নিজস্ব ক্লাবকে নয়, ক্রীড়াঙ্গনে অন্য অংশীদারদের দিকে যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এটি নজিরবিহীন। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতি এবং ভাবমূর্তি বৃদ্ধিকল্পে এই গ্রুপের ‘ডাইরেক্ট পৃষ্ঠপোষকতা’ বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের ক্রীড়া ইতিহাসে তুলনাহীন।

প্রথম থেকেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ফুটবল অন্তপ্রাণ মো. ইমরুল হাসান। এখনো ব্যস্ততার মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে ফুটবল খেলেন আনন্দের সঙ্গে। পেশাদার মানসিকতাসম্পন্ন ক্লিন ইমেজের এই ব্যক্তিত্ব পেরেছেন সহযোগী সবাইকে পেশাদার মানসিকতায় একত্র করতে। তিনি বিশ্বাস করেন, উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সবার পার্টিসিপেশনের কোনো বিকল্প নেই। এই ক্লাবের গভর্নিং বডিতে ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করা হয় না, ব্যবহার করা হয় ‘আমরা’। সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি ক্লাব পরিকল্পনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি, শৃঙ্খলা এবং সুশাসনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলেই খেলতে নেমেই বিপিএলে একনাগাড়ে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ক্লাব। সৃষ্টি করেছে দেশের ফুটবলে নতুন ইতিহাস। ক্লাবটি দেশের ফুটবলে বড় ‘বিজ্ঞাপন’ হতে পেরেছে। বসুন্ধরা কিংস পরিচিত হয়েছে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে।

বাফুফের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২৬ অক্টোবর। এটি ফিফার সম্মতিক্রমে অনেক আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। চার বছরের জন্য ১৩৩ জন কাউন্সিলর ২১ সদস্যবিশিষ্ট গভর্নিং বডির নেতা নির্বাচিত করবেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করায় বাংলাদেশ থেকে ফিফার কাছে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করা হয়েছিল। ফিফা এই আবেদনে সায় দেয়নি। জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে ঘোষিত তারিখে সব ধরনের প্রক্রিয়া ও নিয়ম অনুসরণ করে।

আসন্ন নির্বাচনে কোনো কোনো পরিচিত মুখ—যাঁরা ফুটবল ফেডারেশনে দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁরা কেউ কেউ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনৈতিকতা এবং দলীয় রাজনীতিকে ফুটবলে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে নিজের থেকেই অংশ নিচ্ছেন না। কেউ আড়ালে গেছেন, কেউ দেশান্তরী হয়েছেন, কেউ জেলে আছেন, আবার কেউ বলেছেন অনেক বছর থাকলাম আর কত!

ফিফা এবং এএফসির দৃষ্টি এখন বাংলাদেশে নিবদ্ধ। তাদের কাছে প্রতিদিনের আপডেট আছে। ফিফা জানে গুরুত্বপূর্ণ পদে যাঁরা নির্বাচন করছেন। আসন্ন নির্বাচনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো চারজন মহিলা ফুটবল সংগঠক এবার সদস্য পদে (১৫টি সদস্য পদ আছে) নির্বাচন করছেন। আরেকটি বিষয় হলো দেশের রাজনৈতিক দল ফিফার নির্বাচনে দলীয়ভাবে মাথা ঘামায়নি। রাজনীতি করেন এমন কারো পছন্দনীয় পার্টি থাকতে পারে, এটি তাঁর নিজস্ব ব্যাপার।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এটি প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এই নির্বাচনের আবার অন্য রকম গুরুত্ব। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ফিফার গাইডলাইন অনুযায়ী। ফিফা কখনো এ ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ এবং খবরদারি পছন্দ করে না। তাদের লক্ষ্য একটাই, ফুটবলের নেতা নির্বাচিত হতে হবে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। আর কাউন্সিলররাই তাঁদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত করবেন। আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সদস্য পদে শুধু ভোট হবে। সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ভোটের প্রয়োজন নেই। দুজন প্রার্থী ছিলেন। এর মধ্যে একজন প্রার্থী শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলরদের মনোভাব অনুধাবন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী ছিলেন গতবারের নির্বাচনে (২০২০) ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভোটে নির্বাচিত, বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট, মহানগরী লীগ কমিটি এবং পেশাদার ফুটবল লীগ কমিটির পরীক্ষিত চেয়ারম্যান জনপ্রিয় ফুটবল সংগঠক মো. ইমরুল হাসান। এবার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন শিল্পপতি থেকে ফুটবল সংগঠক, সাইফ স্পোর্টিংয়ের স্বত্বাধিকারী (সাইফ পাওয়ার বিপিএল থেকে নাম প্রত্যাহার করেছে) এবং চট্টগ্রাম আবাহনীর পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন। প্রথমে তরফদার সাহেব ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। জাঁকজমক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়ে এবং প্রচুর প্রেস কাভারেজও পেয়েছেন। এরপর তিনি জানিয়েছেন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অনেক নাটক মঞ্চায়ন করে কাউন্সিলরদের মনোভাব বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত তিনি সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন মো. ইমরুল হাসান। ইমরুল হাসানের প্লাস পয়েন্ট গত চার বছর তিনি দুটি কমিটিতে সবাইকে নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁর কাজের ধরন সবার কাছে পছন্দনীয় হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সবার সম্মতিতে তিনি প্রচুর পরিবর্তন এনেছেন। অনেক ইতিবাচক বিষয় সংযোজন করেছেন। এদিকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর অন্যতম হলেন তাবিথ আউয়াল। ২০১২ ও ২০১৬-তে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজে একসময় ফুটবল খেলেছেন। দায়িত্ব পালনকালে এই সংগঠক তাঁর মেধা এবং যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। ২০২০ উপনির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করলেও জিততে পারেননি। তাবিথ আউয়াল বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর দলীয় রাজনীতিকে টেনে আনেননি। এবার শুধু সময়ের ব্যাপার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার। আমরা চাইব তাবিথ আউয়াল ও মো. ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে নতুন কমিটি দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া 

বাংলাদেশ সময়: ১০২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০২৪
এসআইএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।